ঢাকা প্রতিনিধি: একাদশ জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, প্রকৃত বিরোধী দল না থাকা এবং প্রধান বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
রোববার ‘পার্লামেন্টওয়াচ; একাদশ জাতীয় সংসদ; প্রথম হতে ২২তম অধিবেশন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করা হয়।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সংসদীয় কার্যক্রমে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা পরিলক্ষিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের কাছে প্রত্যাশিত ভূমিকা নিশ্চিতে গবেষণা প্রতিবেদনে ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা এবং মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন জোটভুক্ত দল হিসেবে সংসদীয় কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে এবং সংসদকে কার্যকর করে তুলতে বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকা পালনে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে প্রধান বিরোধীদলের অবস্থান ছিল প্রান্তিক এবং সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা ছিল সার্বিকভাবে গৌণ। ক্ষেত্র বিশেষে প্রধান বিরোধী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অন্যান্য বিরোধী দলের পর্যালোচনা ও সমালোচনা প্রাধান্য পেয়েছে যা প্রধান বিরোধী দলের দ্বৈত ভূমিকা ও পরিচয়কে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
বাজেট কার্যক্রমে ব্যয়িত সময়ের ৮০.১ শতাংশ সময় ব্যয় হয় বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায়, ১৫.৮ শতাংশ সময় ব্যয় হয় মঞ্জুরি দাবির ওপর আলোচনায় এবং ৪.১ শতাংশ সময় ব্যয় হয় বাজেট উপস্থাপনে। বাজেট আলোচনায় ব্যয়িত সময়ের ৩৫.৭ শতাংশ সময় ব্যয় হয় বাজেট সংক্রান্ত আলোচনায় এবং বাকি সময় ব্যয় হয় অন্যান্য আলোচনা, দলের প্রশংসা এবং অন্য দলের সমালোচনায়।
গবেষণায় দেখা যায়, সংসদীয় কার্যক্রমে সদস্যদের অনুপস্থিতি, যথাযথ গুরুত্ব সহকারে অংশগ্রহণ না করা, প্রতিপক্ষের মতামত প্রকাশে বিঘ্ন ঘটানো ও মতামত গ্রহণ না করার প্রবণতার কারণে কার্যক্রমসমূহের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। স্থায়ী কমিটিগুলোর নিয়মিত বৈঠকের ঘাটতি বিশেষত, দেশের জরুরি পরিস্থিতিতেও সংশ্লিষ্ট কমিটিসমূহের বৈঠক করার প্রতি গুরুত্বহীনতাও পরিলক্ষিত হয়েছে। বিধি অনুযায়ী প্রত্যেক কমিটির প্রতিমাসে নূন্যতম একটি করে সভা করার নিয়ম থাকলেও, কোনো কমিটিই সে নিয়ম পালন করেনি। নূন্যতম নির্ধারিত সভা সংখ্যার ৬৬.১ শতাংশ সভাই অনুষ্ঠিত হয়নি। করোনাকালে (মার্চ ২০২০—আগস্ট ২০২১) একটিও সভা করেনি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। করোনাকালে প্রথম ১৮ মাসের ১৩ মাসই কোনো সভা করেনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি।
এ ছাড়া সংসদে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত পদক্ষেপ, অর্জিত লক্ষ্য, চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনার ঘাটতি ছিল। পাশাপাশিসংসদ সদস্যদের একে অপরের প্রতি এবং সার্বিকভাবে সুশীল সমাজের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে বিধি বহির্ভূত আচরণ লক্ষ্য করা যায়। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কোনো কোনো নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক এবং আপত্তিকর শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বিরোধী দলের তুলনায় সরকারি দলের সদস্যদের ক্ষেত্রে এই ব্যত্যয় অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়েছে। সদস্যদের অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার বন্ধে সদস্যদের সতর্ক করা বা শব্দ এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে স্পিকারকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
এ ছাড়া সংসদে ও কমিটিতে সদস্যদের উপস্থিতি, সংসদীয় কার্যক্রমের বিবরণী, সংসদ সদস্যদের সম্পদের হালনাগাদ তথ্য, সংসদীয় কার্যক্রমের কার্যবিবরণী ইত্যাদি স্বপ্রণোদিতভাবে উন্মুক্ত করার উদ্যোগেরও ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, কোরাম সংকটে মোট ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট ব্যয় হয় যা সংসদ কার্যক্রমের মোট ব্যয়িত সময়ের ৬.৫ শতাংশ। কার্যদিবস প্রতি গড়ে ১৪ মিনিট ৮ সেকেন্ড ব্যয় হয়। ৮৪ শতাংশ কার্যদিবসে নিধার্রিত সময় হতে বিলম্বে অধিবেশন শুরু হয় এবং ১০০ শতাংশ কার্যদিবসে বিরতির পর নিধার্রিত সময় হতে বিলম্বে অধিবেশন শুরু হয়। সংসদ পরিচালনার প্রতি মিনিটের গড় অর্থমূল্য প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ টাকা। এই হিসেবে কোরাম সংকটে ব্যয়িত সময়ের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার ৭৭৯ টাকা।
উল্লেখ্য, গবেষণায় গুণবাচক ও পরিমাণবাচক উভয় ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সরাসরি সম্প্রচারিত সংসদ কার্যক্রমের রেকর্ড এবং মুখ্য তথ্যদাতাদের (সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা এবং গবেষক) সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী ও কমিটি প্রতিবেদন, সরকারি গেজেট, প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন, বই ও প্রবন্ধ এবং সংবাদপত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। একই সঙ্গে, জানুয়ারি ২০১৯-এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রথম থেকে ২২তম সংসদ অধিবেশনের প্রায় ৭৪৪ ঘণ্টা রেকর্ডিংয়ের অনুলিপি ও নথিপত্র থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশক ও বিষয়বস্তুভিত্তিক ডাটাবেজ প্রস্তুত করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে টিআইবি।
ঢাকা/ইবিটাইমস/এনএল