মো: সোয়েব মেজবাহউদ্দিনঃ ২৭ নভেস্বর, জীবনের ভুলতে না পারা একটি দিন, একটি মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক বাঁচার লড়াইয়ের স্মৃতি। মহান রাব্বুল আল আমিনের অশেষ কৃপায় জীবন মৃত্যুর স্বন্ধিক্ষন থেকে ফিরে আসার লোমহর্ষক সেই স্মৃতি নভেস্বর মাস আসলেই তারা করে বেড়ায়। মনের অজান্তে চোখ থেকে গড়িয়ে পরে অশ্রু ফোটা। হাহাকার করে উঠে হৃদয়। পানির ভিতর দীর্ঘ ৬ ঘন্টা লে র কেবিনে আটকা পরে প্রচন্ড শীতের মধ্যে একা বাঁচার লড়াইয়ে যখন হতাশ হয়ে পরি, তখন কেবিনের ভেতরের নদীর পানি পান করে,“লা ইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ্জলেমিন” পড়তেছিলাম। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও ভুলতে পারি না সেই স্মৃতি।
ভোলার লালমোহনে ঈদের আগের দিন কোকো-৪ ল দূর্ঘটনায় মৃত্যূবরন করেছিল ৮৪ জন যাত্রী। আমিও ছিলাম ঔ লে র যাত্রী। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি বেঁচে যাই। আমার চোখে ভেসে উঠে সেই ভয়াল কালো রাতের কথা। ১৩ বছর পার হতে চলেছে কিন্তু আজও লালমোহনবাসী জানতে পারলনা দূর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা শাস্তি পেয়েছে কিনা। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় তাই এখনও নৌ পথে চলছে চলাচলের অনুপযোগী ল । দূর্ভোগ ও দূর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে সাধারন যাত্রীরা।
সেদিন সকাল ১০.৩০ টার সময় কোকো-৪ ল টি ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। আমি লে র ২য় তলায় সিংগেল কেবিন নিয়ে লঞ্চটিতে যাত্রার শুরু করি। লঞ্চে মালামাল না থাকায় যাত্রীদের হাটাহাটির কারনে লঞ্চটিতে অতিরিক্ত যাত্রীর কারনে একবার ডানদিকে আবার বাম দিকে হেলেদুলে চলতে থাকে। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এদিকে কোন প্রকার দৃষ্টি না দিয়ে লালমোহনের উদ্দ্যেশে চলতে থাকে। ল টি বুড়িগঙ্গা সেতুর কাছে আসার পর কিছু যাত্রী নৌকা করে নেমে যায়। আমি ও একবার নেমে যাওয়ার চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু দিনের ল ভ্রমন করার ইচ্ছায় আর নামতে পারিনি।
লঞ্চটি বড় ছোট অনেক নদী পাড়ি দিয়ে যখন ভোলা সীমানায় প্রবশ করল তখন কিছুটা ভরসা পেলাম। আমার ৭ নং কেবিনে সহ সকল কেবিনের সামনে বিছানার চাদর বিছিয়ে সাধারন যাত্রীদের গাদাগদি অবস্থানের কারনে কেবিন থেকে বের হতে অনেক সমস্যা হত। কেবিন থেকে বের হয়ে নিচে যাওয়ার মত কোন যায়গা ছিল না। যখন যাত্রীদের হাটাহাটির কারনে লঞ্চটি একবার ডানদিকে আবার বাম দিকে হেলেদুলে চলতে থাকে তখন লঞ্চের আনছার বাঁশ দিয়ে পানি ছিটিয়ে যাত্রীদের লঞ্চের বাম ডানে হাটাহাটি বন্ধ করার চেষ্টা করে। লঞ্চ টি দেউলা ঘাট এবং বদরপুর ঘাট করে নৌকার মাধ্যমে কিছু যাত্রী নামিয়ে দেয়। নাজিরপুর টার্মিনালের কাছে এসে টার্মিনালে ঘাট না করে একটু দুরে ঘাট করে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটু পরিমান পানিতে যাত্রীদের নামাতে থাকে। কারণ জানতে পেলাম যাত্রীরা জীবন রক্ষার্থে দ্রুত নামার চেষ্ঠা করার সময় ইন্সপেক্টর উজ্জল লঞ্চের প্রধান ফটক বন্ধ করে টিকিট চেক করতেছে। কেবিন বয় আমাকে এবং আমার পাশের কেবিনের লোকদের বলেন” লঞ্চের অবস্থা ভাল না, আপনারা নাজিরপুর ঘাটে নেমে যান। আমি কেবিন থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চ ডুবে যেত দেখে আমি লঞ্চ থেকে নামার জন্য একটু সামনের দিকে আগানোর চেষ্টা করতেই দেখি সকল যাত্রী তাড়াহুড়া করে বাদিকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আমিও ঝাঁপ দিতে গিয়ে যখন দেখলাম লঞ্চ টা বাদিকে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে আমি ঝাপ না দিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। লঞ্চ টা কাঁত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল আমি ” লা ইলাহা ইল্লাল আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জলেমিন” পড়তেছিলাম। চোখের পলকে কি হয়ে গেল আমি বলতে পারব না। কিছুক্ষন পর পানি হতে ডুব দিয়ে উঠে দেখি আমি এক কেবিনে আটকা পরেছি। চারিদিকে অন্ধকার, শুধু আত্মচিৎকার শুনতে পাচ্ছি, আমিও বাচাও বাচাও বলে চিৎকার করছি আর কেবিনের চারপাশে হাত দিয়ে আঘাত করছি। আমার শরীর কোমর পানিতে ডুবে আছে। আমি আমার পকেট থেকে মোবাইটা বের করে দেখি তা ভিজে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। মোবাইটা চালু করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। ২০-২৫ মিনিট পর শিশু ও মহিলাদের আত্মচিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভাবলাম আমি বুঝি আর বাচবনা। আলাহুর নাম স্মরন করতে থাকি। আর আত্মচিৎকার করতে থাকি। হাতের কাছে কেবিনের খাটের উপর বিছানো কাঠ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আঘাত করতেছি। পাশের কেবিন থেকে বন্ধু মারূফ বললো সোয়েব তুই কোথায়, আমি বললাম, আমি পাশের কেবিনে, মারূফ বললো আমি ও আটকা পড়েছি। আমি দোয়া দুরুদ পড়ছি আর আত্মচিৎকার করছি। এক সময় পুলিশের বাঁশির শব্দ শুনে পুলিশ ভাই আমাকে বাচান বলে, আত্মচিৎকার করছি, আবার এলাকাবাসি কেউ আছেন আমাকে বাচান বলে আত্মচিৎকার করছি। একসময় এক লোক এসে বলল এই রুমে কেউ আছেন ? আমি বললাম, ভাই আমি আছি আমাকে বাচান, লোকটি একটি সাবল দিয়ে কিছুক্ষন চেষ্টা করে চলে গেল। আমি কিছুটা হতাশ হলাম।
আবার আত্মচিৎকার করতে থাকলাম। বেচে থাকার আসা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কেবিনের খাটের আরার উপর বসে আমি আমার বাবা ও মায়ের কথা, আমার বোন, ভাই এবং সদ্য বিবাহীত স্ত্রীর কথা ভাবতেছি আর অঝর ধারায় কাঁদছি। আমার শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করে, মনে হয়েছিল, আমার জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। আমি হয়ত আর বাঁচবনা, আমি আমার শরীরের বেলেজার, জামা, এবং পায়ের জুতা খুলে ফেলি। পায়ের নিচের মাটি কেটে শুরঙ্গ তৈরী করে বের হওয়ার পরিকল্পনা করি। কাছাকাছি কিছ মানুষের কণ্ঠ শুনে কেবিনের জোরার ঝালাই করার স্থানে দুই হাত এক করে জোড়ে বাচাও বাচাও বলে আত্মচিৎকার করি। এক লোক বলতেছে এই রুমে জীবিত লোক আছে। আমি আমার মাথার উপরে কাঠ দিয়ে আঘাত করলাম তারপর কেবিনের জোরার ঝালাই করার স্থানে কিছটা ফাঁক দিয়ে আঙ্গুল বের করে দেখালাম আমার লোকেশন। উদ্ধারকারীরা আমার আঙ্গুল দেখে এগিয়ে আসে। কেউ বলে সাবল নিয়ে আয়, কেউ বলে হাতুরী নিয়ে আয়। আমি ভরসা পেলাম।
৪/৫ জন লোক যখন আমাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছে আমি দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আলার নাম জপতে লাগলাম। অক্লান্ত পরিশ্রম করে লোকেরা যখন কেবিনের এক কোণার পাত কাটতেছে আমি শুধু অধির আগ্রহ এবং এক বুক আশা নিয়ে ফালফাল তাঁকিয়ে রইলাম আর তাদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। দীর্ঘক্ষন চেষ্ঠা করে তারা একটু ফাক করে টর্চের আলো দিয়ে আমাকে খোঁজার পর আমি হাত উচিয়ে আমাকে দেখালাম। তারা আমাকে উদ্ধার করার মত ফাঁক করে আমাকে বললো আপনি হাত উচু করে আমাদের হাত ধরেন আমরা আপনাকে টেনে তুলব। আমি হাত দিয়ে তাদের হাত ধরলাম, তারা ৪ জন আমার দুহাত ধরে আমাকে আস্তে আস্তে টেনে তুলতেছে আমি তখন নিশ্চিত হলাম যে, আমি বেচে আছি। আমি উপরে উঠার পর উদ্ধারকারীদের জরিয়ে ধরে কান্না করলাম। তখন কাউকে চিনতে পারলাম না। দু’জন আমাকে ধরে লঞ্চ থেকে নামিয়ে একটি জেলে নৌকাতে উঠালো। পরে জানতে পেরেছি আমাকে উদ্ধারকারী একজন হলো প্রকৌশলী আবু সালেহী।
ভোর ৪.৩০ মিনিটের সময় মাংশ ব্যবসায়ী জাকির হাওলাদার ও ভাই সাইফুল এর সাথে মটর সাইকের যোগে বাসায় ফেরার পথে জাকির হাওলাদারের মোবাইলে আমার মায়ের মোবাইলে ফোন করি, আমার ছোট বোন নীলা, যাকে আমি আদর করে নীলি বলি, ফোন রিসিভ করে, আমি তাকে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলি, হ্যালো, আমি সোয়েব, আমি বেঁচে আছি, বাসায় আসছি, সে বললো আপনি কে, কেন মিথ্যে কথা বলে শান্তনা দিচ্ছেন। আমি যখন বললাম, নীলি, আমি সত্যি বলছি, আমি সোয়েব, তখন সে, চিৎকার করে বলে উঠল, আম্মা সোয়েব ভাইয়া, বেঁচে আছে, ফোন করেছে।
তারপর ফোন করলাম সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীকে। তার ফোন রিসিভ করে তার এক ভাবী, আমি তাকে বললাম, হ্যালো, আমি সোয়েব, আমি বেঁচে আছি। তার ভাবীও বললো, আপনি কে, কেন মিথ্যে কথা বলছেন। আমার স্ত্রীর নাম লাকী, যাকে আমি লাকু বলি, লাকু আমি সত্যি বেঁছে আছি, তখন তার ভাবী মোবাইলটা তার হাতে দেয় আমি তাকে বলি লাকু, আল্লাহ আমাকে বাচিঁয়ে রেখেছেন।
বাসায় এসে দেখি আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীতে ভরপুর। বাসায় পৌছে রাব্বুল আলআমিনের নিকট শুকরিয়া আদায় করি।
লেখক: মিডিয়া কর্মী
ডেস্ক/ইবিটাইমস