বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত

বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সূত্র থেকে বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছেন প্রচণ্ড চাপের কাছে নতিস্বীকার করে পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন

ইউরোপ ডেস্কঃ বিবিসি ও রয়টার্স জানায়, আজ বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) জনসন তার দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন। এদিকে বৃটিশ স্কাই নিউজ আরও জানিয়েছে, বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকেও ইস্তফা দেবেন।

একের পর এক বরিস জনসনের মন্ত্রী সভার একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও কর্মকর্তা পদত্যাগ করার পর সিদ্ধান্ত বদল করতে চলেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। বিবিসি জানাচ্ছে, জনসন টোরি দলের নেতৃত্ব ছাড়ছন। তাই প্রধানমন্ত্রীর পদও ছাড়তে হচ্ছে তাকে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়ার জন্য কিছুটা সময় পাবেন তিনি। কারণ, পরবর্তী নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকবেন। নতুন নেতা নির্বাচনে কিছুটা সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

আজ বৃহস্পতিবার কোন এক সময় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। বিবিসি ও স্কাই নিউজ আরও জানাচ্ছে, সেখানেই তার সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন জনসন।

এদিকে গতকাল বুধবার জনসনের দুই গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ এবং অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।তারপরেও জনসন পার্লামেন্টারি কমিটিতে জানিয়েছিলেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না । কিন্তু তারপর একের পর এক মন্ত্রী ও কর্মকর্তা পদত্যাগ করতে শুরু করেন। তার প্রতি এই অনাস্থার প্রকাশ দেখে চাপের মুখে পড়ে জনসনও অবশেষে সিদ্ধান্ত বদল করলেন। সবমিলিয়ে এই পর্যন্ত তার সরকারের মোট ৫৭ জন মন্ত্রী ও কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন।

এদিকে জার্মানির সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলে (DW) জানায়,এর আগে জনসন বলেছিলেন, ”আমি এখন ইস্তফা দিচ্ছি না। কারণ, দেশ এখন নির্বাচন চায় না। আমি সেই সব বিষয়ের উপর নজর দিচ্ছি যা দেশের জন্য জরুরি। ইউরোপে গত ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের দিকে আমি মনোনিবেশ করছি।” পার্লামেন্টারি কমিটিতে জনসন বলেছেন, ”আমি সব সমস্যার মুখোমুখি হতে চাই, পালিয়ে যেতে চাই না।”

এরপর তিনি আবাসন মন্ত্রী মাইকেল গভকে ডেকে পাঠিয়ে ইস্তফা দিতে বলেন। ব্রেক্সিট নিয়ে মাইকেল গভ সরকারের তরফে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু বুধবার তিনি বলেন, দেশ ও দলের স্বার্থে জনসনের পদত্যাগ করা উচিত। জনসনের পার্লামেন্টের সচিব জেমস ডাডরিজ স্কাই নিউজকে জানান, ”মাইকেল গভকে বরখাস্ত করেছেন জনসন। প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো চনমনে আছেন এবং তিনি লড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।”

বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি করোনাকালে বিধি ভেঙে পার্টি করেছেন। তার জন্য একটি ক্ষেত্রে তিনি জরিমানাও দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি এমন একজনকে চিফ হুইপ করেছেন, যার বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। তা জেনেও জনসন তাকে চিফ হুইপ করায় দলে প্রচুর জলঘোলা হয়েছে।

পদত্যাগ করার পর সাবেক মন্ত্রী সাজিদ জাভেদ পার্লামেন্টে বলেন, তিনি ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বরাবর টিম প্লেয়ার হিসাবে কাজ করে এসেছেন। কিন্তু যখন ক্যাপ্টেন ভালো হয়, তখন টিমও ভালো হয়। গত কয়েক মাস ধরে যা হচ্ছে, তাতে টিমে থাকা আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।

এক নজরে বরিস জনসনের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত: ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন ৷

চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কানে কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷ কিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।

তারপর ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন ৷

টেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি ৷

টেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।

যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের ৷

জনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে ৷

প্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।

বাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কিভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি ৷

তথ্যসূত্র:রয়টার্স, বিবিসি ও ডয়েচে ভেলে

কবির আহমেদ/ইবিটাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »