আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ভয়েস অফ আমেরিকার খবরে বলা হয়েছে,উভয় দেশের রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে তাদের আনুষ্ঠানিক আবেদনপত্র পাওয়ার পর বুধবার ন্যাটো জোটের মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ ব্রাসেলসে জোটের সদর দপ্তরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা জানান।
ভয়েস অফ আমেরিকা আরও জানায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ন্যাটো জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্যপদ পাবার আবেদনে ‘হ্যাঁ বলবেন না’ বলা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র “নিশ্চিত” যে তাদের সদস্যপদে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এই জোটের মধ্যে “দৃঢ় ঐকমত্য রয়েছে।” এখানে উল্লেখ্য যে, তুরস্ক সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জোটে প্রবেশ নিয়ে অনেকদিন থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছিল।
ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট রিজেব তায়েব এরদোগান পরিষ্কার জানিয়েছিলেন যে,নর্ডিক দেশ দু’টিকে পশ্চিমা সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করায় তাদের ‘ইতিবাচক মতামত’ নেই। এর ফলে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোয় যোগদান অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ জোটে ঢুকতে হলে এর ৩০ সদস্যেরই সম্মতি প্রয়োজন তাদের।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান অভিযোগ করেছেন, ফিনল্যান্ড-সুইডেন উভয়ই ‘সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর’ পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কারণ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো সন্ত্রাসী সংগঠনের গেস্টহাউজের মতো। উত্তর ইউরোপীয় দেশগুলো বিশেষ করে সুইডেন কুর্দি সংগঠন এবং ২০১৬ সালে ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জড়িত অভিযুক্ত ফেতুল্লাহ গুলেনকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এ দিন ১৯৫২ সালে গ্রিসের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তিতে তুরস্কের সাবেক শাসকদের সম্মতি দেয়া ‘ভুল’ ছিল বলেও মন্তব্য করেন এরদোগান। তিনি বলেন, আমরা এই ইস্যুতে দ্বিতীয়বার ভুল করব না।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রতিবেশী ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোয় যোগ দেয়ার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। উভয় দেশই যত দ্রুত সম্ভব পশ্চিমা এ সামরিক জোটের সদস্য হতে চায়। ইতি পূর্বে ন্যাটো প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গও জানিয়েছিলেন, তারা দুই হাত খুলে নর্ডিক দেশ দু’টিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। তবে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কই প্রথম এ বিষয়ে আপত্তি জানাল।
নিয়ম অনুসারে, কোনো দেশ ন্যাটো সদস্য হতে আবেদনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ৩০ সদস্যের এ জোট থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে তার জন্য প্রত্যেক সদস্যের সম্মতির প্রয়োজন হয়। এরপর শুরু হয় সদস্যপদের জন্য সমঝোতা। তুরস্ক বা অন্য কোনো সদস্য আপত্তি না জানালে ফিনল্যান্ড-সুইডেনের ন্যাটোয় যোগদানের চূড়ান্ত অনুমোদন হতে পারে আগামী জুনে অনুষ্ঠিতব্য “মাদ্রিদ সম্মেলনে।” তবে কোনো সদস্য আপত্তি করলে বা সমঝোতা না হলে নর্ডিকদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেতে পারে।
এরদোগানের এ অবস্থান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারে। ম্যাক্রোঁ এর আগে দাবি করেছিলেন, তুরস্কের আচরণের কারণে ন্যাটো এখন ‘ব্রেইন ডেথ’ হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোতে প্রবেশে সব দিক থেকেই সমর্থন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। যদিও এর আগে তুরস্কের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছিল ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তোর।
ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের আবেদন স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকে তাদের দীর্ঘ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ঐতিহাসিক প্রস্থান নিশ্চিত করে। কিন্তু গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী ইউক্রেনকে মস্কোর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত উভয় দেশে বিশেষ করে রাশিয়ার সাথে অভিন্ন দীর্ঘ সীমান্ত থাকা ফিনল্যান্ডে ভীতির জন্ম দিয়েছে।
রোববার নর্ডিক দেশ দুটি পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোতে যোগ দিতে চাওয়ার ঘোষণার পরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমকে সতর্ক করেছেন যে, নেটো ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনে তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করলে মস্কো প্রতিক্রিয়া জানাবে।
আগামী বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসন এবং ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তোর সাথে সাক্ষাতের সময় তার ব্যক্তিগত সমর্থন প্রদান করবেন বলে ভয়েস অফ আমেরিকা কূটনৈতিক সূত্রে এক ঈন্গিতে একথা জানিয়েছে।
এদিকে তুরস্কের সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছেন ন্যাটোতে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি ইস্যুতে তুরস্ক কিছু শর্ত সাপেক্ষে রাজি হতে পারে বলে জানিয়েছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোর সদস্য হতে হলে তুরস্কের শর্ত মানতে হবে। রুশ বার্তা সংস্থা স্পুতনিক জানিয়েছে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে শর্ত দিয়েছে তুরস্ক সরকার।
আঙ্কারা বলেছে, তুরস্কের সম্মতি পেতে হলে অস্ত্র রপ্তানি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটাতে হবে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনায় আঙ্কারার উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা প্রত্যাহার করতে হবে।
তুরস্ক মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সব সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য সদস্যগুলোর পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা ও চাপের মুখে ছিল। এ কারণে তুরস্কের জনগণ ন্যাটোর সদস্য হিসেবে থাকার বিরোধী।
প্রথমে ফিনল্যান্ড এবং তারপর সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটো জোটে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বলেন, তারা ঐ দুই দেশের ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করবেন।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাটো জোটে ১৯৫২ সালে যোগ দেয় তুরস্ক। মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই জোটে নতুন সদস্য গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে এই জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে তুরস্ক।
কবির আহমেদ /ইবিটাইমস