৯ম পর্ব
ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ ৯১। পরিবর্তিত পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিকতার আলোকে বর্তমানে আমাদের দেশে বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত অপ্রিয় মনে হলেও সত্য যে, জাসদ গঠন করার পর থেকে বঙ্গবন্ধুকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করার দিনটি পর্যন্ত অবিভক্ত জাসদের ভূমিকা ও কার্যক্রম ছিল চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং প্রচণ্ড রকমের হঠকারিতাপূর্ণ। জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মেজর (অবঃ) এম এ জলিল এবং সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব – এর বক্তৃতার ভাষা ছিল অশালীন, অমার্জিত এবং শিষ্টাচার বহির্ভূত। যে সংসদে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংসদ নেতা এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী – পল্টনের জনসভায় বক্তৃতা প্রদানকালে সেই সংসদকে উদ্দেশ্য করে আ স ম আবদুর রব বলেছেন – “এই পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়।” তার রুচিজ্ঞান, শালীনতাবোধ এবং আচরণ কতটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ, ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং উস্কানিমূলক ছিল উপরোক্ত বক্তৃতার ভাষা থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গভীর বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, একীভূত জাসদের এহেন মারমুখো ভূমিকা, হঠকারিতাপূর্ণ মনোভাব এবং নীতি- নৈতিকতা বিবর্জিত অবস্থানের পুরো সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিসমূহ। এরই ধারাবাহিকতায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ মদদ ও সহযোগিতায় বিপথগামী কতিপয় নরাধম সৈন্য অত্যন্ত নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ইতিহাসের এই নির্মম সত্যকে অস্বীকার করার মতো কিংবা ইনিয়ে বিনিয়ে অথবা বাকচাতূর্যের মাধ্যমে তা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো কোন সুযোগ কিংবা কোন অবকাশই নেই।
৯২। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো পরাশক্তিসমূহ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি বরং সর্বান্তকরণে বিরোধিতা করেছে। এরই পাশাপাশি সৌদি
বলয়ের প্রভাবাধীন মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলো পাকিস্তানকে তাদের নিরাপত্তার জন্য অন্যতম ঢাল হিসেবে মনে করতো। তাই পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি এবং বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে
কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। আর ঠিক একারণেই বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি রাজতন্ত্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঐ সময়ে ক্ষমতাসীন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বাংলাদেশের নাগরিকদেরকে পবিত্র হজ্জব্রত পালন করার অনুমতি ও প্রদান করেননি। এমতাবস্থায় আমাদের দেশের নাগরিকদেরকে তখন ভারতীয় পরিচয়ে হজ্জে যেতে হতো। যা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক এবং অবমাননাকর।
৯৩। দীর্ঘদিন ধরে সামরিক স্বৈরশাসকদের দ্বারা শাসিত পাকিস্তানের মতো অগণতান্ত্রিক এবং নির্বিচারে গণহত্যাকারী একটি রাষ্ট্রের বর্বর সেনাবাহিনীর সাথে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই পাকিস্তানের সাথে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক ও রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং মতপার্থক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল এবং তা’ ছিল ও বটে। কিন্তু সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের কোন ব্যাপারেই কোন বিরোধ কিংবা মতপার্থক্য ছিলনা। এহেন অবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে পবিত্র হজ্জব্রত পালন করার সুযোগ না দেয়াটা নীতি- নৈতিকতার পাশাপাশি ইসলাম সম্মত ছিল কিনা এবং তা ধর্মীয়ভাবে সমর্থনযোগ্য কিংবা অনুমোদনযোগ্য তথা ‘জায়েজ’ ছিল কি না তা তৎকালীন ক্ষমতাদর্পী বাদশাহ আদৌ
অনুধাবনই করতে চাননি এবং তা করেন ও নি। নৈতিক, মানবিক এবং ধর্মীয় বিবেচনায় যা ছিল নিদারুণভাবে গর্হিত, অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
৯৪। বিস্মৃতিপ্রবণ বাঙালি জাতি তাদের স্মৃতির পাতা উল্টালে নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারবেন যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময় পর্যন্ত গোলাম আজমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে। তারা ঐ সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করার জন্য রাজাকার, আলবদর এবং আল শামস বাহিনী গঠন করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের পরাজয় অত্যাসন্ন বুঝতে পেরে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে গোলাম আজম বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। পরে সেখান থেকে সৌদি আরবে গিয়ে আশ্রয় নেন। এই সৌদি আরবে বসেই তিনি “পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি” গঠন করেন। আর পাকিস্তানী পাসপোর্টধারী এই গোলাম আজমকেই জিয়াউর রহমান সসম্মানে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। পরে খালেদা জিয়ার আমলে তাকে নাগরিকত্ব ও ফিরিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জিয়া এবং তার স্ত্রী কতটা আন্তরিক ছিলেন এবং এরই পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামের কাছে তারা কতটা অসহায় ও দায়বদ্ধ তথা committed ছিলেন অন্যান্য আরও অসংখ্য দৃষ্টান্তসমূহের পাশাপাশি এই ঘটনা থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
৯৫। প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক যে, ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাঁরই মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ সংবিধান লংঘন করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এরই পাশাপাশি তিনি ঐদিন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সামরিক আইন জারি করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের সংবিধানকে বাতিল করা হয়নি কিংবা স্থগিত ও করা হয়নি। তাই সামরিক আইন জারি করা সত্ত্বেও সংবিধান যথারীতি বহাল এবং বলবৎ ছিল। এমতাবস্থায় সংবিধানের ৫৪ নং অনুচ্ছেদের ভাষ্য মোতাবেক, দেশের রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা তার অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে রাষ্টপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্র মতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত – উপরাষ্ট্রপতি এবং উপ-রাষ্ট্রপতি না থাকলে সংসদের স্পীকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন বলে বর্ণিত রয়েছে। স্বীকৃত মতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্টে দেশের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং স্পীকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। অথচ তাদেরকে ডিঙ্গিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদ জবরদখল করেন তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তাই তিনি শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর খুনীই নন, একই সঙ্গে তিনি সংবিধান লংঘনকারী ও বটেন।
৯৬। দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখার নিমিত্তে শপথ নিয়ে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন এ এস এম সায়েম। দেশের অবৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৮২ দিন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অসম্মানজনকভাবে সরিয়ে দেয়া হয়। এহেন অবস্থায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় বসানো হয় এ এস এম সায়েমকে। এমতাবস্থায় দেশের ক্ষমতাসীন প্রধান বিচারপতিই হয়ে গেলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি। কিন্তু অসাংবিধানিক সরকারের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি হওয়ার মতো কোন সুযোগ কিংবা কোন অবকাশ সাংবিধানিকভাবেই তার ছিল না। তদুপরি তার এহেন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারটি তার শপথের সাথে কোনভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ কিংবা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ছিল না। সুতরাং অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশের প্রধান বিচারপতিও
তার শপথের মূল্য রাখেননি কিংবা রাখতে পারেননি বরং অমর্যাদা করেছেন এবং তা ভঙ্গ ও করেছেন। আর এহেন শপথ ভঙ্গের মাধ্যমে তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়া সত্ত্বেও সংবিধান লংঘন করেছেন। যা ছিল দেশ ও জাতির জন্য নিদারুণভাবে দুঃখজনক এবং হতাশাব্যঞ্জক।
৯৭। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দেশের সেনাবাহিনী প্রধান এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত থাকাবস্থায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এরই পোষকতায় তিনি ও রাতের অন্ধকারে অসাংবিধানিকভাবে দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতির পদ জবরদখল করে নেন। সুতরাং স্বীকৃত মতেই প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োজিত থাকাবস্থায় শপথ ভঙ্গ করে এবং সংবিধান লংঘন করে জিয়াউর রহমান
স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। যা ছিল সম্পূর্ণভাবে অন্যায়, অবৈধ এবং পুরোপুরিভাবে বেআইনী। ইতিহাসের আলোকেই একথা সত্য যে, খন্দকার মোশতাক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনী এবং সংবিধান লংঘনকারী স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট। এহেন অবস্থায় তিনি নিজে এবং অন্যান্য খুনীদেরকে বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি Indemnity Ordinance জারি করেন। তারই পদাঙ্ক অনুসরণকারী এবং সংবিধান লংঘনকারী অপর এক অবৈধ এবং বর্ণচোরা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অপরাধ উন্মোতিচ হয়ে যাওয়ার ভয়ে মৌলিক এবং মানবাধিকার হরণকারী উপরোক্ত কুখ্যাত অধ্যাদেশটিকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি সেটিকে আইনে পরিণত করেন।
৯৮। পৃথিবীর সব দেশেই যে কোন ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা একটি সভ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা
করা সত্ত্বেও রাষ্ট্র তথা সরকার উদ্যোগী হয়ে এহেন বর্বর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উপরন্তু তাদেরকে নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। এরই পাশাপাশি খুনীদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে সম্মানজনক চাকরি দিয়ে
পুরস্কৃত করেছেন এবং তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছেন। তারও পরে সংবিধান সংশোধন করে এহেন পাশবিক এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে দিয়েছেন। যা ছিল চরম অনৈতিক, প্রচণ্ড রকমের অমানবিক এবং সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লংঘন। এমতাবস্থায় অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক যে, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে মহামান্য হাইকোর্ট উপরোক্ত পঞ্চম সংশোধনীকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। এরই পাশাপাশি খন্দকার মোশতাক, এ এস এম সায়েম এবং জিয়াউর রহমান কর্তৃক উপরোল্লিখিতভাবে অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রপতির পদ দখল করাকে সম্পূর্ণভাবে অবৈধ, বেআইনী এবং জবরদখল বলে তা বাতিল এবং অস্তিত্বহীন বলে রায় প্রদান করেছেন। উপরন্তু মোশতাক, সায়েম এবং জিয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহী এবং সংবিধান ধ্বংসকারী হিসেবেও ঘোষণা করেছেন। মহামান্য হাইকোর্টের উপরোক্ত রায় সংবিধানের ১১১ নং অনুচ্ছেদের ভাষ্য মোতাবেক দেশ এবং জাতির জন্য বাধ্যতামূলক এবং অবশ্য পালনীয় বটে।
৯৯। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় যারা সার্বক্ষণিকভাবে ছিলেন তাঁর অনুকম্পা প্রত্যাশী এবং অনুগ্রহভোগী সেই খুনী মোশতাক এবং তার চতুর সহচর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাঁর চরিত্র হননের অপচেষ্টায় মেতে উঠেন। তাদের এহেন
দুরভিসন্ধিনূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা, বানোয়াট এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে ভরা কল্পকাহিনী রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অবিরামভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। এরই পোষকতায় বছরের
পর বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের কুৎসা এবং ভিত্তিহীন অপপ্রচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নির্মল চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করা হয়। সামরিক শাসকদের পদলেহী এবং উচ্ছিষ্টভোগী কতিপয় সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং চরম বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী কিছু উগ্র এবং অতি বামপন্থী নেতৃবৃন্দ এই সমস্ত অপপ্রচার খুবই নিষ্ঠার সাথে এবং পরম আন্তরিকতার সাথে পালন করেন। বাঙালির হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য তারা স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং বিরামহীনভাবে তাদের এহেন নৈতিকতা বিবর্জিত অপচেষ্টা এবং অপতৎপরতা তারা অব্যাহত রেখেছেন।
১০০। স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষগুলির জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার দিন থেকে তাঁর নামে কিংবা তাঁর পক্ষে কোন কিছু বলা কিংবা প্রচার করা বিশেষ করে ৭ই মার্চের উপরোক্ত কালজয়ী ভাষণ বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশন থেকে প্রচার করা বন্ধ করে দেয়া হয়। খন্দকার মোশতাক, জিয়া, বিচারপতি সাত্তার, এরশাদ এবং খালেদা জিয়া- প্রমুখেরা রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধান থাকাকালীন সময় পর্যন্ত উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞার আদেশ কঠোরভাবে বহাল থাকে। এমনকি জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ৭ই মার্চের ভাষণের সমস্ত ক্যাসেট এবং এতদ সংক্রান্ত সমুদয় সাক্ষ্য প্রমাণাদি বেতার ও টেলিভিশন ভবন থেকে বিনষ্ট করে দেয়া হয়েছিল বলে ঐ সময়ের তথ্য মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রণব সাহা অপুর সঞ্চালনায় ATN News -এর টক শো -তে উপস্থিত হয়ে একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় স্বনামে আর্টিকেল লিখে যিনি ৭ই মার্চের ভাষণকে আমাদের স্বাধীনতার জন্য Green signal বলে আখ্যায়িত করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেই জিয়াউর রহমানই উপরোক্ত কালোত্তীর্ণ ভাষণের ক্যাসেট এবং সমুদয় সাক্ষ্য প্রমাণাদি বিনষ্ট করে ফেলার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তার এহেন অপরিণামদর্শী এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ নির্দেশ বেতার এবং টিভি কর্তৃপক্ষ যথারীতি পালন করেন।
১০১। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ যে মানুষটির কণ্ঠ সাড়ে সাত কোটি নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল, যিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে তাঁর দেশ ও জাতিকে মুক্ত করেছেন, রাষ্ট্রের সকল গণমাধ্যমে তাঁর নাম উচ্চারণ করা পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন ও সংগ্রাম করে, জেল-জুলুম-অত্যাচার নিরবে হজম করে এবং মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন বাজি রেখে যে নেতা বিশ্ব মানচিত্রে একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করলেন, জাতিকে দিয়ে গেলেন একটি পতাকা এবং গর্বিত পরিচয়, তাঁর নামে কোন কিছু প্রচার করা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলার প্রতিটি গরিব দুঃখী মানুষের প্রতি যার ছিল অফুরন্ত ভালবাসা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ- গোত্র নির্বিশেষে একান্ত আপনভাবে ভালবাসতে পারার জন্য যে মানুষটি পরিণত হয়েছিলেন
গণ মানুষের নেতায়, তাঁর সংগ্রাম মুখর জীবনের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী আড়াল করে তদস্থলে প্রচার করা হলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং দুরভিসন্ধিমূলক অপপ্রচার। এহেন অবস্থায় ১৯৭৫ সন থেকে ১৯৯৬ সন পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২১ টি বছর ধরে একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এই সমস্ত মিথ্যা, বানোয়াট এবং বিভ্রান্তিমূলক গল্প শুনে শুনে। এমতাবস্থায় এই প্রজন্মের Mindset পরিপূর্ণ হয়েছে প্রকৃত সত্য এবং গৌরবান্বিত ইতিহাসের পরিবর্তে বিভ্রান্তিমূলক কল্পকাহিনী এবং অসত্য তথ্যাবলী দ্বারা। দেশ এবং জাতির জন্য যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক।
১০২। পৃথিবীর যে কোন দেশেরই স্বাধীনতার ঘোষণা সেই দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এহেন ঘোষণা প্রদানের জন্য ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অত্যাবশ্যক এবং অপরিহার্য। কোন ক্যাপ্টেন কিংবা মেজর বাঁশিতে ফুঁক দিয়ে হুইসেল বাজালেই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করা যায় না। এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয় এবং প্রেক্ষাপট ও তৈরী করতে হয়। আর এহেন অত্যন্ত কঠিন এবং দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি তাঁর সারা জীবন ধরে অকুতোভয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে তাঁর দেশ ও জাতিকে পর্যায়ক্রমে এবং ধাপে ধাপে প্রস্তুত করেছেন। দেশবাসীর মনে স্বাধীনতার স্পৃহা এবং আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় খুবই সঠিক সময়ে এবং চরম মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এহেন ঘোষণার মাধ্যমে চিরকাল ধরে অবহেলিত বাঙালি জাতিকে তিনি একটি ভৌগলিক ঠিকানা দিয়েছেন। একটি সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর বাঙালিদের সার্বভৌম অধিকার নিশ্চিত করেছেন।
দেশবাসীকে একটি মানচিত্র প্রদান করেছেন এবং একটি পতাকা উপহার দিয়েছেন। তাঁর এহেন অসামান্য অবদানের মাধ্যমে তিনি সারা পৃথিবীর মানুষদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ এমন একটি জাতিরাষ্ট্র যা কোন দান কিংবা অনুগ্রহের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। এই দেশের স্বাধীনতা কোন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অর্জিত হয়নি। বরং অপরিমেয়
রক্তমূল্যে খরিদ করা হয়েছে। বাঙালি জাতি তার নিজস্ব শক্তিতে, নিজেদের ক্ষমতায় এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে তার স্থান করে নিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতি তাদের জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব এবং পরিচয় বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
১০৩। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তার আত্মপরিচয়ের কোন সন্ধান ছিল না। এমনকি তার আত্মপরিচয়ের কোন স্বীকৃতি ও ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতির এহেন গ্লানি, দুঃখ এবং মর্মবেদনার অবসান ঘটিয়েছেন। এই জাতির অন্তর্জালা দূরীভূত করে অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা এবং বেদনাও তিনি ঘুচিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ব মানচিত্রে এখন
বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক। বর্তমানে এই জাতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আবাসভূমি রয়েছে। পরিচয় দেয়ার মতো ঠিকানা রয়েছে, একটি পতাকা রয়েছে এবং একটি জাতীয় সংগীত ও রয়েছে। সবকিছুর উপরে রয়েছে একটি অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতি একমাত্র জাতি যারা তাদের মাতৃভাষার সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। এমতাবস্থায় এই জাতির রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। এরই পাশাপাশি এই জাতির রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি ও সভ্যতা। দেশমাতৃকার মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের মতো এত বড় ত্যাগ স্বীকার এবং এত বেশি পরিমাণে রক্ত দেয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে আর কোন জাতিরই নেই। তাই আজ বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ এবং বীরের জাতি হিসেবে স্বীকৃত এবং প্রমাণিত। আর এই গর্বিত ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
১০৪। দেশের সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকই জানেন যে ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের মহান স্বাধীনতা এবং মুক্তির অমিয় বাণী সমৃদ্ধ একটি কালজয়ী ভাষণ। যুদ্ধের ময়দানে এই ভাষণের প্রতিটি বক্তব্যই মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ছিল উদ্দীপ্ত চেতনার চির প্রদীপ্ত বাতিঘর। এই ভাষণের মাধ্যমে সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্ন ভাবে একটি জাতির স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে বলে
সুধীজনেরা মনে করেন। এরই পাশাপাশি অত্যাসন্ন মুক্তিযুদ্ধের কৌশল, রণনীতি এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনসাধারণের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে যে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তার তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ভাষণের অনেক দিক নির্দেশনা এবং বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো বঙ্গবন্ধু এইদিন কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রদান করেননি। উপরন্তু যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে সুদৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে সম্বোধনের ব্যাপারে বিনয় এবং সৌজন্যবোধ বজায় রেখেছেন। তাদের প্রতি পরিমার্জিত এবং পরিশীলিত ভাষা প্রয়োগ করেছেন। এরই পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের প্রতি যে সম্মান এবং অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তা সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এইদিন তাঁর দরাজ কণ্ঠে যেমন ফুটে উঠেছে ২৪ বছরের শোষণ বঞ্চনার করুণ ইতিহাস, ঠিক তেমনি তাঁর সুচিন্তিত এবং
সুবিন্যস্ত বাক্যচয়নের মাধ্যমে তিনি উচ্চারণ করেছেন একেকটি প্রেরণাদায়ক শব্দ। এদিন তাঁর কণ্ঠস্বরের উঠা-নামা, মুখাবয়ব এবং বাচনভঙ্গি – এর সবটাই ছিল অভিনব, অভূতপূর্ব এবং অবিস্মরণীয়। তাই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাপূর্ণ এই ভাষণ তার আপন মহিমায় ইতিমধ্যে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পেরেছে এবং তা বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিপুলভাবে সমাদৃত ও হয়েছে।
১০৫। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি বাঙালি রয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর একটি বৃহত্তর অংশ জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক এবং এই দেশের স্থায়ী বাসিন্দা। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য বাঙালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। জন্মসূত্রে কিংবা অন্য কোনভাবে তারা বিভিন্ন দেশের নাগরিক হতে পারেন, কিন্তু জাতিগত পরিচয়ের দিক দিয়ে তারা সবাই বাঙালি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী আজ তাই অসংকোচে, অকপটে এবং গর্বের সাথে বলতে পারে আমি বাঙালি, আমার ভাষা বাংলা, আমার ঠিকানা বাংলাদেশ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের বুকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সমৃদ্ধ করেছেন এবং মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরই পাশাপাশি ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে বাংলা ভাষায় এক কালজয়ী এবং মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়ে এই ভাষণকে “বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল” হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে বাঙালি
জাতিকে উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু। স্বীকৃত মতেই এই জ্বালাময়ী এবং তেজোদীপ্ত ভাষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ এবং অনুপ্রাণিত হয়ে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় অর্জন করে বীর বাঙালি জাতি বিশ্বের বুকে অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আর এই যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর নামেই পরিচালিত হয়েছে এই যুদ্ধ।
ড. মোঃ ফজলুর রহমান, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ), লেখক ও কলামিস্ট
(চলবে)
বি/ইবিটাইমস/এম আর