পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে প্রদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি রাশিয়ার
ইউরোপ ডেস্কঃ বৃটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে রাশিয়া আজ মঙ্গলবার অতি প্রত্যুশে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কে ট্যাঙ্ক এবং সৈন্য পাঠিয়েছে। বিবিসি আরও জানান রাশিয়ান সৈন্যদের ইউক্রেনে এই অনুপ্রবেশের অর্থ রাশিয়া ইউক্রেনে তার হামলা ও আগ্রাসন শুরু করে দিয়েছে বলে মনে করছে বৃটিশ সরকার। ফলে ইতিমধ্যেই বৃটিশ সরকারের নীতি নির্ধারকরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে।
এদিকে পূর্ব ইউক্রেন থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে মঙ্গলবার অনেক ভোর থেকেই রাশিয়ান সৈন্যদের ট্রাক বহর ঝাঁকে ঝাঁকে পুর্ব ইউক্রেনে ঢুকতে দেখা গেছে।
এদিকে গতকাল রাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন ভাষণে বলেছেন, মস্কো পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ এক বক্তব্যে মি. পুতিন ইউক্রেনের সম্পর্কে বলেন, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি যেটা ‘পুতুল সরকারের’ মাধ্যমে চলছে।
তিনি বলেন, “ইউক্রেন কোন দিনই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না এবং আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।” ইউক্রেনকে নেটোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ধারণাকে তিনি রীতিমত আক্রমণাত্মক ভাবে বলেন “এটা সরাসরি রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি”। মি. পুতিন যুক্তি দেন, নেটো রাশিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টা আমলে নেয়নি।
ভাষণ শেষ করার সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরও বলেন যে, রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলোকে স্বীকৃতি দেবে রাশিয়া। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে বিদ্রোহীদেরকে লক্ষ্য করে গুলি করা বন্ধ করতে হবে, না হলে এর পরিণতি মোকাবেলা করতে হবে।
এর কিছু পরেই বিদ্রোহী অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি দুইটা ডিক্রিতে সই করেন। সেখানে বলা হয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী সেখানে “শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে”।
তবে “শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত” থাকার অর্থ আসলে কী – সেটি নির্দিষ্ট করে বলেনি রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়া এবং ইউক্রেনের বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিন এখন “আনুষ্ঠানিকভাবে” ইউক্রেনের বিদ্রোহী এলাকাতে রুশ সৈন্য পাঠাতে পারবে।
রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে রাশিয়ান সৈন্যদের ইউক্রেনে অনুপ্রবেশের ঘটনায় অস্ট্রিয়ার স্থানীয় একটি সম্প্রচার কেন্দ্রের সাথে এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রিয়ার ফেডারেল প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ফান ডার বেলেন বলেন,
“ইউক্রেনে অনুপ্রবেশ করে রাশিয়ার তার লাল রেখা অতিক্রম করা ফেলেছে”।
অস্ট্রিয়ার ফেডারেল প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ফান ডার বেলেন পূর্ব ইউক্রেনে আগ্রাসনের রুশ আদেশকে “ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার” স্পষ্ট লঙ্ঘন হিসাবে দেখছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন “ইউক্রেনের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছে এবং তার নিজের লোকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার মাধ্যমে একটি লাল রেখা অতিক্রম করেছেন।”
ফেডারেল প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, পুতিন ডোনেটস্ক এবং লুহানস্কে রাশিয়ান সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে কূটনীতি এবং সংলাপের প্রচেষ্টা ধ্বংস করার ঝুঁকি নিচ্ছেন। প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অলঙ্ঘনীয় একটি অপরাধ।
এটি আমাদের ইউরোপীয় প্রতিবেশী ইউক্রেনের পাশাপাশি অন্যান্য সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পূর্ব ইউক্রেনে মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। আমি রাষ্ট্রপতি পুতিনের কাছে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য এবং সংঘাতের পরিবর্তে সংলাপের পথ গ্রহণ করার জন্য আবেদন করছি,” বলেছেন ফেডারেল প্রেসিডেন্ট।
এদিকে আজ অস্ট্রিয়ার মন্ত্রী পরিষদের এক নিয়মিত বৈঠকের পর এক অপ্রত্যাশিত জরুরী সংবাদ সম্মেলন ডাকেন অস্ট্রিয়ার সরকার প্রধান চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার। নেহামার বলেন,রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের টেলিভিশন বক্তব্য ও পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ইত্যাদির সমস্ত লক্ষণ ইউক্রেন সঙ্কট এখন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে অস্ট্রিয়াও শঙ্কিত। সোমবার সন্ধ্যায়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে পূর্ব ইউক্রেনে রুশ সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেন। অস্ট্রিয়া ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের সাথে উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করছে, চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার (ÖVP) সঙ্কট মন্ত্রিসভার আরেকটি বৈঠকের পরে বলেছেন: “আমরা এখনও সমঝোতার শীর্ষে পৌঁছাতে পারিনি।”
তিনি আরও বলেন গতকাল সোমবার সন্ধ্যায়, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে পূর্ব ইউক্রেনে রুশ সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেন। অস্ট্রিয়া ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার (ÖVP) সঙ্কট মন্ত্রিসভার আরেকটি বৈঠকের পরে বলেছেন: “আমরা এখনও আলাপ-আলৌচনার শীর্ষে পৌঁছাতে পারিনি।”
নেহামার বলেন, গত কয়েক ঘণ্টায় যা ঘটেছে তা হল “আমরা যা ভয় পেয়েছিলাম এবং আমরা যা সতর্ক করেছিলাম তাই হচ্ছে।” রাশিয়া স্বঘোষিত গণপ্রজাতন্ত্রী লুখানস্ক এবং দোনেস্ককে স্বীকৃতি দেওয়ার পরে এবং পুতিন “শান্তি রক্ষাকারী সৈন্য” প্রেরণ করার পরে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে খারাপ হয়েছে। এটি প্রথমবার নয় যে রাশিয়া “ফ্যান্টম স্টেট” তৈরি করেছে, চ্যান্সেলর বলেছেন, দক্ষিণ ওসেটিয়া এবং আবখাজিয়াকে স্মরণ করে, যেগুলি ২০০৮ সালে ককেশাস যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া দ্বারা স্বীকৃত হয়েছিল।
এদিকে অস্ট্রিয়ান সংবাদ সংস্থা এপিএ জানিয়েছে অস্ট্রিয়ায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাস্ট্রদূতকে আজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে অস্ট্রিয়া পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের আনুষ্ঠানিক সরকারি প্রতিবাদ জানাবে।
অস্ট্রিয়ার সরকার প্রধান চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার আরও বলেন,পূর্ব ইউক্রেনের এলাকাগুলোর স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি মিনস্ক চুক্তির সুস্পষ্ট বিরোধী। চ্যান্সেলর জোর দিয়ে আরও বলেন যে অস্ট্রিয়া, ইইউ কমিশনের সাথে পরামর্শ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপকে সমর্থন করবে।
ইইউ দেশ সমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আজ কোন এক সময়ে ব্রাসেলসে জরুরী বৈঠকের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। নেহামার বলেন,এই ধরণের নিষেধাজ্ঞাগুলি এখন লক্ষ্যবস্তুতে ব্যবহার করা উচিত কারণ আমাদের ধরে নিতে হবে যে আমরা এখনও যুদ্ধের মত সিদ্ধান্তের শীর্ষে পৌঁছাইনি।
অস্ট্রিয়ার ১২ জন OSCE পর্যবেক্ষক যারা বর্তমানে ইউক্রেনে রয়েছেন, তারা আপাতত সেখানেই থাকবেন। অস্ট্রিয়া এমনকি আরও পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে। “আমরা সামরিকভাবে নিরপেক্ষ, কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হয় তখন আমাদের একটি স্পষ্ট অবস্থান থাকে। অস্ট্রিয়ার কণ্ঠস্বর ইইউতে ওজন বহন করে এবং আমরা এই সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছি যে আইনের শক্তি কর্মের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে, কিন্তু রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শক্তিশালীদের অধিকার নয়।”
“যুদ্ধ অগণিত পরাজয় সৃষ্টি করে – বিশেষ করে মা, মহিলা এবং শিশু”। তারা বর্তমানে কিভাবে অস্ট্রিয়া ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রাখতে পারে তাও পরীক্ষা করছে৷ নেহামার বলেছেন যে তিনি ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ফোনে এই বিষয়ে কথা বলেছেন: “সবকিছু সত্ত্বেও, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে কূটনীতি যেন স্থবির হয়ে না যায়৷ “আপনাকে ইউরোপে থাকতে হবে কিন্তু একবার আপনি এই অবস্থানে পৌঁছেছেন যে সশস্ত্র সংঘাত অগণিত পরাজয় সৃষ্টি করবে, চ্যান্সেলর জোরালো ভাষায় বলেছেন: “বেশিরভাগই মা, মহিলা এবং শিশু। এর ফলে মানুষের জীবন এবং ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যাবে।” তাই অস্ট্রিয়া OSCE-এর সহযোগিতায় সংলাপ চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিশেষভাবে তৈরি করা সংকট মন্ত্রিসভা যতদূর উদ্বিগ্ন, এটি তার মূল্য প্রমাণ করেছে, এবং বিশেষ করে শক্তি সরবরাহের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল: “যদিও রাশিয়া আজ সমস্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, জ্বালানি মন্ত্রীর মতে, শক্তি সরবরাহ নিরাপদ। দীর্ঘমেয়াদী সরবরাহ ব্যর্থতার ক্ষেত্রে ইইউ কমিশনও বিকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অস্ট্রিয়ার পরিবারগুলিতে এটি ঠান্ডা হয় না – এমনকি যখন ঋতু ঠান্ডা হয়, “নেহামার জোর দিয়েছিলেন।
সংবাদ সংস্থা এপিএ আরও জানিয়েছে,আশঙ্কা করা হচ্ছে পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের ফলে তৈরি সঙ্কটে উপদ্রুত এলাকার প্রায় ১ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় দশ লাখ মানুষ উদ্ভাস্ত হতে যাচ্ছে। তবে অস্ট্রিয়ার সাথে ইউক্রেনের কোন সীমান্ত না থাকায় আপাতত অস্ট্রিয়া এই উদ্ভাস্ত সমস্যায় পড়ছে না। অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে এখনও ১৫০ জন অস্ট্রিয়ান ইউক্রেনে অবস্থান করছেন। তবে রাশিয়ান সৈন্য প্রবেশের পরেও সেখানকার পরিস্থিতি এখনও শান্ত এবং নিরাপদ।
যদি পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়,তাহলে পূর্ব ইউক্রেনে অবস্থান রত অস্ট্রিয়ানদের দ্রুত রাজধানী কিয়েভে ফিরে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকার প্রধান চ্যান্সেলর কার্ল নেহামার জানান,অস্ট্রিয়াতেও ইউক্রেনীয় স্থাপনা গুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যেমন,দূতাবাস ও বিভিন্ন সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়ীক সংগঠন ইত্যাদি।
কবির আহমেদ/ ইবিটাইমস