১০ ম পর্ব
ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ ৯১। দেশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করেন তারা নিশ্চয়ই জানেন বিগত ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান রেডিও মারফত জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। উক্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন- “… Mujib is a traitor to the nation. This time he will not go unpunished… .” অত্যন্ত হৃদয় বিদারক হলেও সত্য যে, সেনাপতি ইয়াহিয়ার উপরোক্ত অনভিপ্রেত ভাষণ সত্ত্বেও তার দেশ পাকিস্তানে নয় বরং উক্ত ভাষণের- “… সাড়ে চার বছর পরে তার হুকুম তালিম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিচার হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক আদালতে। তাঁর মৃত্যুদণ্ড ও হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখা হয়েছিল। ইয়াহিয়া খান যখন গদিচ্যূত হন, তিনি ভুট্টো সাহেবকে বলেছিলেন, আমি সই দিচ্ছি, আপনি কার্যকর করুন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব রাজি হননি। রাজি হননি আন্তর্জাতিক চাপে। রাজি হননি মার্কিন সরকারের চাপে। রাজি হননি তাদের দোসরদের জান বাঁচানোর জন্য। রাজি হননি এক লক্ষ পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে রক্ষা করার জন্য। তাই সেদিন বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড স্থগিত ছিল। পরে কার্যকর হবে যেদিন তাদের মতলব হাসিল হয়ে যাবে। সেদিন কার্যকর হবে। তাই হয়েছিল। ইয়াহিয়ার সেই কথা কার্যে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭১ সনের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুকে যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তা কার্যকর করা হয়েছিল ৪ বছর পরে ১৯৭৫ সনের আগস্ট মাসে।” [দ্রঃ বঙ্গবন্ধুঃ ইতিহাসের মহানায়ক- বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, সূত্রঃ বাংলার কথা, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, মুক্তধারা প্রকাশনী, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ১০]।
৯২। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণে পাকিস্তানের বাংলাদেশী ভাড়াটে সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাদের প্রভু ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আর তা পালনের মাধ্যমে তারা তাদের চরম ক্ষোভ, প্রবল প্রতিহিংসা এবং পাশবিক জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ঘাতকদের প্রধান রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক এবং ষড়যন্ত্রের শিরোমণি বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মুশতাক আহমেদ পরে ১৯৭৫ এর ২০শে আগস্ট মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে অব্যাহতি দেন এবং তদস্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। তারও পরে ২৬-০৯- ১৯৭৫ ইং তারিখে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি Indemnity Ordinance জারি করেন।
অত্যন্ত দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক এবং হৃদয় বিদারক হলেও সত্য যে, দেশদ্রোহী কুলাঙ্গার ঘাতকেরা এহেন মর্ম বিদারক এবং চিত্ত বিদারক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা সত্ত্বেও এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার করা যাবেনা বলে বঙ্গবন্ধুরই এককালীন
সহযোগী এবং স্বঘোষিত ও জবরদখলকারী রাষ্ট্রপতি তার উপরোক্ত Indemnity Ordinance -এর মাধ্যমে নির্দেশনা প্রদান করেন। এই কুখ্যাত Ordinance টি ছিল মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকার হরণকারী একটি চরম অমানবিক অধ্যাদেশ। তাই এই বিতর্কিত অধ্যাদেশটি আমাদের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদের বক্তব্যের সাথে পুরোপুরিভাবে সাংঘর্ষিক বলে খোলা চোখেই পরিলক্ষিত হয়।
৯৩। পরবর্তীকালে খন্দকার মুশতাক ক্ষমতার মসনদ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তারই উত্তরসূরী এবং তার দ্বারা পদোন্নতি প্রাপ্ত সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই মিডিয়াতে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু কিংবা জাতির পিতা বলা যাবে না বলে অলিখিতভাবে নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করেন। এছাড়া পত্রপত্রিকাতেও মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি “জয় বাংলা” এবং জয় বঙ্গবন্ধু লেখা যাবে না বলেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় উপরোক্ত কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিকে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে তা’ সংসদে পাশ ও করিয়ে নেন।
তারও পরে একাধিকবার ক্ষতবিক্ষত হলো আমাদের সংবিধান। দেশের সংবিধান থেকে মুছে দেয়া হলো সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এরই ফলশ্রুতিতে বাঙালি হারালো তাদের আত্মপরিচয়। এর পর থেকে একে একে হারাতে থাকলো বাঙালির সমুদয় অর্জন। অর্থাৎ যা কিছু সত্য ও সুন্দর এবং দীর্ঘদিনে বাঙালির যা কিছু অর্জন তার সবই একে একে চলে গেল নষ্টদের অধিকারে। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং সভ্যতা বার বার পদদলিত হলো ক্ষমতা লিপ্সু এবং অপরিণামদর্শী সামরিক শাসকদের সঙ্গিনের খোঁচায়। অতপর আমাদের ভাগ্যাকাশে নেমে এলো দীর্ঘতম সূর্যগ্রহণ।
৯৪। দেশের আপামর জনসাধারণ নিশ্চয়ই জানেন, ১৯৭২ -এর ১২ই জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধু জিয়াউর রহমানকে চার চারটি পদোন্নতি দিয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল বানিয়েছেন। আর সেই উচ্চাভিলাসী এবং সুচতুর জিয়াই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর উপরোল্লিখিত চরম বিতর্কিত ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্সটিকে তিনি পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। বেঈমানী, মুনাফেকি এবং বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে এটি একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ বটে।
একটি রাষ্ট্র কতটা অসভ্য, বর্বর এবং অমানবিক হলে এহেন একটি চরম অগণতান্ত্রিক এবং অমানবিক অধ্যাদেশকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তা ভাবতে গেলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, ইতিহাসের বরপুত্র ক্ষণজন্মা বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি আজ আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাঁর জন্য আমরা আজ কিছুই করতে পারবনা। আমরা শুধু পারি বছর বছর কাঁদতে। আমাদেরকে এই কান্নার অধিকারটা দিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অত্যন্ত নির্দয় এবং নির্মম ভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমাদেরকে কাঁদতেও দেয়া হয়নি। তাঁর ঘাতকেরা এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সুবিধাভোগীরা কতটা প্রতিশোধপ্রবণ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল, তাদের এহেন চরম অনৈতিক ও অমানবিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
৯৫। অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর পাষণ্ড খুনী লেঃ কর্নেল (অবঃ) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেঃ কর্নেল (অবঃ) খন্দকার আবদুর রশিদ বিবিসি-তে পৃথক পৃথকভাবে প্রদত্ত সাক্ষাতকার প্রদানের মাধ্যমে সরাসরি এবং অকপটে (Clearly and categorically) স্বীকার করেছে যে, জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ মদদ এবং পূর্ণ সমর্থন নিয়েই তারা এই বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার পূর্বে অন্যতম খুনী ক্যাপ্টেন মাজেদ ও সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট (Conspicuously and unequivocally) ভাবে স্বীকার করেছে যে, জিয়াউর রহমানের জ্ঞাতসারে এবং তার পুরোপুরি ইন্ধনেই তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।
সুতরাং এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জিয়াউর রহমানের পূর্বাপর জড়িত থাকার সত্যতা এবং সম্পৃক্ততা উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার ভয়েই এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ রাখার জন্য তিনি মৌলিক এবং মানবাধিকার হরণকারী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্সটিকে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন বলে অকাট্ট এবং জোরালো (Undoubtedly and trustworthily) ভাবেই প্রমাণিত হয়।
৯৬। কোন একটি অধ্যাদেশ কিংবা কোন আইন দ্বারা যদি কোন নৃশংস এবং বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করা হয়, তাহলে সেই আইন কোন সভ্য দেশের কিংবা কোন সভ্য সমাজের আইন হতে পারেনা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে তা করা হয়েছে। তাই Indemnity Ordinance -টিকে একটি সভ্য দেশের জন্য অসভ্য আইন বললে কোনভাবেই অত্যুক্তি হয়না। এরই পাশাপাশি অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ১৯৭৫ সালের পরবর্তী কোন একটি সরকারই এই জঘন্য এবং মানবতা বিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল কিংবা রহিত করেননি। উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদেরকে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়েছে। একটি দেশের স্থপতি তথা জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত (Self confessed) একজন নরাধম এবং পাষণ্ড খুনী রাষ্ট্রদূত হিসেবে তারই দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে পৃথিবীর অন্য দেশে গিয়ে। এর চেয়ে দুঃখ, লজ্জা এবং অপমানের আর কিছুই হতে পারে না। বর্বর খুনীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এহেন পুনর্বাসন, পুরস্কৃত এবং পৃষ্ঠপোষকতা করার মাধ্যমে দেশের সম্মান কিংবা মর্যাদা কোনভাবেই বাড়েনি। বরং বহির্বিশ্বে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
৯৭। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য তৎকালীন বৃটিশ এমপি টমাস উইলিয়ামকে প্রধান করে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন গঠিত হওয়ার পর তারা ঢাকায় আসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং প্রস্তুতি ও সম্পন্ন করেন। ঐ সময়ে দেশে প্রেসিডেন্ট ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তদন্ত কমিশনের কাউকেই ঢাকায় আসার জন্য কোন ভিসা দেননি। যার অন্তর্নিহিত কারণ সমূহ অত্যন্ত সন্দেহজনক এবং রহস্যাবৃত (Suspicious and mysterious) বলে বিবেচিত হয়। উপরোক্ত পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের সাথে জিয়াউর রহমান কোনভাবেই জড়িত কিংবা সম্পৃক্ত না থাকলে, তিনি উক্ত তদন্ত কমিশনকে তাদের তদন্ত কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে দিতে পারতেন। এমনকি তদন্তে সহযোগিতাও করতে পারতেন। কিন্তু স্বীকৃত মতেই তিনি তা দেননি বা করেননি। সঠিক এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হলে প্রকৃত সত্য এবং তথ্য বেড়িয়ে আসতে পারে বলে এবং তার সংশ্লিষ্টতা উন্মোচিত হয়ে যেতে পারে বলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই তিনি (জিয়াউর রহমান) তা করতে দেননি বলে সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়।
৯৮। আমরা সবাই জানি যে, পৃথিবীর একাধিক দেশের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতা এমনি এমনি তথা কোন চুক্তির মাধ্যমে আসেনি। বরং অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট এবং অপরিমেয় আত্মত্যাগের পাশাপাশি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এই দেশের স্বাধীনতার আনুপূর্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বহুল আলোচিত “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার” বাংলাদেশী জনৈক বিচারককে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশেরই রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছেন। পরে আবার তাকে
মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি ও নিয়োগ করেছেন। এরই পাশাপাশি উপরোল্লিখিত মামলার সহকারী তদন্ত কর্মকর্তাকেও পুরষ্কৃত করে জিয়ার শাসন আমলে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও বানানো হয়েছে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণকারী এবং বিভিন্নভাবে তাঁর ঘোরতর বিরোধিতাকারীদেরকে এভাবে প্রবল আগ্রহের সাথে খুঁজে বের করে জিয়াউর রহমান কর্তৃক এহেন রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক বলে জোরালোভাবেই বিবেচিত হয়।
৯৯। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদেরকে বিচারের আওতায় না আনার নিমিত্তে খন্দকার মুশতাক আহমেদের কুখ্যাত Indemnity Ordinance জারি করেছেন। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান উক্ত Ordinance -টিকে আইনে পরিণত করেছেন এবং খুনীদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি প্রদান করে পুরস্কৃত করেছেন। তারও পরে রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত এক খুনী ফারুক রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিয়েছেন তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। অপর এক খুনী
বজলুল হুদাকে চুয়াডাঙ্গা থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ই করে দেয়া হয়েছে। এমনকি আত্মস্বীকৃত অন্য এক চরম দাম্ভিক এবং নৃশংস খুনী খন্দকার আবদুর রশীদকে ১৯৯৬ সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারির ভোটার বিহীন প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে বিনা ভোটে নির্বাচিত করে এনে সংসদে বিরোধী দলের নেতা বানিয়েছেন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। উপরোক্ত যে সমস্ত পথভ্রষ্ট দুর্বৃত্ত এবং কুলাঙ্গার ঘাতকদের প্রাপ্য ছিল অবধারিত মৃত্যুদণ্ড, তা প্রদান না করে এবং তাদেরকে কোন প্রকার বিচারের সম্মুখীন না করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসন সহ বিভিন্ন ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং দেশের রাষ্ট্রদূতের মতো সম্মানজনক চাকরি প্রদানের মাধ্যমে পুরষ্কৃত করা হয়েছে। নরপশু
খুনীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এহেন পুনর্বাসন এবং পুরস্কৃত করা সংক্রান্ত দানবিক এবং পাশবিক ঘটনাবলী অত্যন্ত ন্যক্কারজনক এবং কলংকজনক বলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিরকাল ধরে বিবেচিত হবে।
১০০। উপরোল্লিখিত ঘটনাবলীর আলোকে একথা অনস্বীকার্যভাবেই প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের কুপরামর্শে বাংলাদেশকে ঠিক পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেকাংশে তারা সফল ও হয় বটে। আইন এবং আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যে কোন ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করবেন যে, অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া কিংবা উক্ত অপরাধকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়াটাও গর্হিত অপরাধ। তদুপরি ইচ্ছা করলে অপরাধীকে ক্ষমা করা দেয়া যায়। কিন্তু উক্ত অপরাধীকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুরস্কৃত করা শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী করার শামিল। যা নিন্দনীয় এবং অমার্জনীয় অপরাধ বটে। তাই আমরা স্বীকার করি বা না করি, উপরোক্ত অপরাধে আমরা সবাই অপরাধী। একটি সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে এর চেয়ে দুঃখ, লজ্জা এবং অপমানের আর কি হতে পারে? তাই সময়ের বিবর্তনে তথা অনাগত ভবিষ্যতে আমাদেরকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে বলে জোর দিয়েই বলা যায়।
ড. মোঃ ফজলুর রহমান, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ) , লেখক ও কলামিস্ট
(চলবে)
বি রি/ ইবিটাইমস/ এম আর