ইন্দিরা গান্ধীর নাতনী কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ান্কা গান্ধী ও নোবেল বিজয়ী মালালা সহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সাধারণ জনগণ মুসকান খানকে সমর্থন জানিয়েছেন
আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ভারতের জনপ্রিয় সম্প্রচার কেন্দ্র এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বিবি মুসকান খান দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডি এলাকার একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির বাণিজ্যিক বিভাগের ছাত্রী।
খবরে প্রকাশ বোরকা-হিজাব পরে বাইক চালিয়ে নিজের কলেজে আসেন মুসকান খান। তখন গেরুয়া উত্তরীয় পরা গোটা পঞ্চাশেক যুবক তার দিকে তেড়ে আসেন এবং ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেন। এ সময় মুসকান সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সামনে হেঁটে আসেন। পেছনে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে যুবকদের আসতে দেখে মুসকান ‘আল্লাহু আকবার’ ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিতে থাকেন।
কেহ একজন এই দৃশ্য মোবাইলে রেকর্ড করে নেটে ছেড়ে দেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা সমগ্র উপমহাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। গেরুয়া উত্তরীয় পরা একদল যুবকের সামনে বোরকা-হিজাব পরে একাই প্রতিবাদ জানিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকের এই কলেজ ছাত্রী মুসকান।
তাৎক্ষণিক তার এই সাহসী ঈমানি ভূমিকার জন্য পাঁচ লাখ রুপি পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। ভারতের টাইমস নাউ নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) এ পুরস্কার ঘোষণা করে ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। টুইট বার্তায় জমিয়তের সভাপতি মাওলানা মাহমুদ আসআদ মাদানির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়।
টুইট বার্তায় বলা হয়, নিজের আইনি ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় তীব্র বাধার মুখেও একাই পুরো দলের প্রতিবাদ করায় সাহসী ছাত্রী মুসকান খান বিনতে মুহাম্মদ হুসাইন খানের প্রতি শুভেচ্ছা। জমিয়তের পক্ষ থেকে এই সাহসী তরুণীর জন্য পাঁচ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, কলেজে হিজাব পরা নিয়ে চরম বিতর্ক চলছে কর্ণাটকে। গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবক ও হিজাব পরা শিক্ষার্থীদের চরম উত্তেজনার মধ্যেই রাজ্যের সব স্কুল-কলেজ তিন দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
রাজ্যজুড়ে চলা উত্তেজনার মধ্যে বোরকা-হিজাব পরে কলেজ ক্যাম্পাসে এসে হয়রানির শিকার হয়েছেন মুসকান খান। এ সময় তিনি একাই প্রতিবাদ করেছেন। একদল যুবকের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের সামনে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে অবিচল থেকেছেন ওই ছাত্রী। এ ঘটনার ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।
ভিডিওতে দেখা যায়, বোরকা-হিজাব পরে বাইক চালিয়ে কলেজে আসেন মুসকান। তখন গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবকেরা তার দিকে তেড়ে আসেন এবং ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেন। এ সময় মুসকান সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে সামনে হেঁটে আসেন। পেছনে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে যুবকদের আসতে দেখে মুসকান ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেন। সেখানে মুসকানকে বাঁচাতে দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।
মুসকান পরবর্তীতে এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ওই যুবকদের বেশির ভাগ বহিরাগত। তারা কলেজের শান্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। হিজাব নিয়ে কলেজের হিন্দু বন্ধুরা কিছু না বললেও বহিরাগত যুবকরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন।
ওই সময়কার বর্ণনা দিয়ে মুসকান বলেন, আমি ভয় পাইনি। কলেজে ঢোকার সময় আমি বোরকা পরা দেখে তারা আমাকে ঢুকতে দিতে চাইছিল না। তারা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে থাকলে আমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে শুরু করি। কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রভাষকেরা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন এবং আমাকে সুরক্ষা দিয়েছেন।
গেরুয়া উত্তরীয় পরা যুবককের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কাছে শিক্ষার প্রাধান্য সবার আগে। কিন্তু তারা আমাদের শিক্ষা ধ্বংস করে দিতে চাইছে। আমরা হিজাব ও বোরকা পরে বহুদিন ধরেই কলেজে আসছি। কিন্তু হিজাব বিতর্ক গত সপ্তাহে শুরু হয়েছে। এই কলেজ ছাত্রী বলেন, হিজাব আমাদের একটি অংশ। মুসলিম মেয়ে হিসেবে এটা আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা হিজাব রক্ষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব।
প্রসঙ্গ, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উদুপির গভর্নমেন্ট গার্লস পিইউ কলেজে ছয় ছাত্রীকে মাথায় হিজাব পরে আসায় ক্লাসে ঢুকতে দেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ওই দিন থেকে আন্দোলন শুরু হয়, ক্রমে তা রাজ্যের অন্য স্কুল-কলেজগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে উদুপি ও চিক্কামাগালুরে ডানপন্থী সংগঠনগুলো ছাত্রীদের হিজাব পরে কলেজে প্রবেশের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিবাদ জানাতে থাকে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে কলেজে সংঘর্ষও হয়। হিজাব ইস্যুতে রাজ্যের বহু স্কুল-কলেজে বিক্ষোভ এখনও অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কর্ণাটক হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার এ মামলার শুনানি চলে। বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিচারক এই মামলার শুনানি আপাতত মুলতুবি ঘোষণা করেন।
এদিকে ইন্দিরা গান্ধীর নাতনী কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ান্কা গান্ধী বলেন,স্বাধীন ভারতে একজন মেয়ে কি পোশাক পড়বে সেটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় কর্নাটকের বোরকা-হিজাব বিরোধীদের উদ্যেশ্য করে বলেন, ভারতীয় সংবিধান একজন নারীকে তার পছন্দের বোরকা, হিজাব ও নিকাব পড়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। প্রিয়ান্কা গান্ধী তার টুইট বার্তায় মুসকানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে হ্যাশ ট্যাগ লাগিয়ে লিখেন,”আমি ভারতীয় নারী,নিজের অধিকার আদায়ের জন্য লড়তে জানি।”
অন্যদিকে বৃটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে গত কয়েক সপ্তাহে কয়েকটি স্কুল ও কলেজে হিজাব পরা মেয়েদের ক্লাসে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। বিতর্ক এখন ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মালালা ইউসুফজাইয়ের এক টুইট স্পর্শকাতর এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
গতকাল (বুধবার) এক টুইটে মালালা লিখেছেন, “হিজাব পরার কারণে মেয়েদের স্কুলে ঢুকতে না দেওয়া ভয়ঙ্কর ব্যাপার। বেশি কাপড় বা কম কাপড় – যেকোন অছিলাতেই নারীদের পণ্য বানানোর প্রবণতা চলছেই।”
মালালা – যিনি নারী শিক্ষার পক্ষে আন্দোলনে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন – তার টুইটে “মুসলিম নারীদের কোণঠাসা করা” বন্ধ করতে ভারতীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মালালা ইউসুফজাইয়ের এই টুইট প্রকাশের পর থেকেই তা নিয়ে – বিশেষ করে ভারতে – ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।শীর্ষস্থানীয় সমস্ত ভারতীয় মিডিয়ায় মালালার টুইট নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। সরগরম হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও।
ভারতের অসাম্প্রদায়িকরা বলছেন, কর্নাটকের উদুপিসহ কয়েকটি জেলা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দক্ষিণপন্থী বিজেপির একটি শক্ত ঘাঁটি। তারা এই অঞ্চলকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি ল্যাবরেটরিও বলে থাকেন। এই এলাকাগুলোতে বেশ কিছু সময় ধরে হিন্দুত্ববাদী কর্মীদের তৎপরতা এবং ঘৃণাসূচক বক্তব্যের কারণে ধর্মীয় বিভক্তি গভীর হয়েছে। ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষতার খেতাব তাদের জন্য প্রায় হারাতে বসতে শুরু করেছে।
কবির আহমেদ/ইবিটাইমস /এম আর