আয়ারল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র এবং ১৯৭৩ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য রাষ্ট্র
কবির আহমেদ, ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়াঃ আধুনিক সার্বভৌম এই রাষ্ট্রটি আয়ারল্যান্ড দ্বীপের পাঁচ-ষষ্ঠাংশ নিয়ে গঠিত। বাকী অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড বৃটেন বা যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত।
প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড (Republic Irland) ১৯২১ সালের ৩ মে গ্রেট ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রথমে আইরিশ ফ্রি স্টেট এবং পরবর্তিতে প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড গঠন করে। দেশটির রাজধানী ডাবলিন যা আয়ারল্যান্ড দ্বীপের সর্ববৃহৎ শহর।
আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের বলা হয় আইরিশ জাতি। দেশটির সরকারি ভাষা আইরিশ ও ইংরেজি। দেশটির সরকার প্রজাতন্ত্রী এবং সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত।
আয়ারল্যান্ডের মুদ্রার নাম ইউরো(€)। দেশটির বার্ষিক জিডিপি (মনোনীত) আনুমানিক মোট $২০২.৯ বিলিয়ন ডলার এবং বার্ষিক মাথাপিছু আয় $৫০,১৫০ ডলার।
আয়ারল্যান্ডের আয়তন ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপটি জুড়ে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়-পর্বত, বেশ কিছু নদী ও হ্রদ। সিলুরিয়ান অধিযুগের ৪১ কোটি ৮০ লক্ষ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে লাউরেশিয়া, বাল্টিক ঢাল-ভূখণ্ড এবং এ্যাভোলিনিয়া ক্রেটনের ভিতরে সংঘর্ষ হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল ইউরোমেরিকা মহামহাদেশ। এই সংঘর্ষের ফলে উৎপন্ন হয়েছিল আয়ারল্যান্ডের পর্বতমালা। উল্লেখ্য এই পর্বতমালাকে বলা হয় ক্যালিডোনীয় গিরিজনি।
দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। এই দিকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে আমেরিকা মহাদেশ। এর মাঝে কোনো দেশ নেই। এর পূর্ব দিকে আইরিশ সাগর, উত্তরে উত্তর সাগর। এই দ্বীপ-ভূমির এক-ষষ্ঠাংশ বৃটেনের অধীনে রয়েছে। এই অংশটি উত্তর আয়ারল্যান্ড নামে পরিচিত।
১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আয়ারল্যান্ড একক রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল। এই রাজবংশকে বলা হয় হাই কিং অব আয়ারল্যান্ড। এরপর এই দ্বীপাঞ্চলে ছোটো ছোটো রাজত্বে ভাগ হওয়া শুরু হয়। ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে পুরো আয়ারল্যান্ড ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। তৎসত্ত্বেও সে সময়ে আয়ারল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা ছিল। ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে এই পার্লামেন্ট ক্রাউন অব আয়ারল্যান্ড এ্যাক্ট পাশ করে। এর ভিতর দিয়ে কিংডম অব আয়ারল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইনে বলা হয় আয়ারল্যান্ডের রাজা বা রানী হবেন ইংল্যান্ডের রাজা বা রানী। এই নতুন আইনে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরী আয়ারল্যান্ডের প্রথম রাজা।
১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা তৃতীয় জর্জ-এর সময় গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের পার্লামেন্টে এ্যাক্ট অব ইউনিয়ন একটি বিল পাশ করে। এই বিলের সূত্রে ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড মিলে তৈরি হয় ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট বৃটেন এন্ড আয়ারল্যান্ড। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি এই নতুন রাষ্ট্রের রাজা হন তৃতীয় জর্জ।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে এপ্রিল যুক্তরাজ্য থেকে আয়ারল্যাণ্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশটি ফ্রি স্টেট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ড নামে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮২ লাখ। এই পর এই দেশের প্রধান খাদ্য আলুর ফলনে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় চরম দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রায় ১০ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে। একই কারণে বহু লোক দেশান্তরী হয়। ফলে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে দেশটির জনসংখ্যা কমে ২৮ লাখে নেমে আসে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ।
আইরিশরা প্রধানত ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ান। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্যাথলিক ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। ধর্মীয় কারণে এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিষিদ্ধ। এখানে প্রকাশ্যে বৈধভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিক্রি হয় না। আইরিশরা পরিবারকে প্রাধান্য দেয়। প্রতিটি পরিবারে শিশুদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধ: আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯১৯ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১৯২১ সালের জুলাই পর্যন্ত চলেছিল। এটি ছিল মূলত আয়ারল্যান্ডে শাসনাধীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) পরিচালিত গেরিলা যুদ্ধ।এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী আইআরএ ছিল প্রথম দায়াল (Dáil) এর অধীন। উল্লেখ্য, প্রথম দায়াল বলতে ১৯১৯ সালের নির্বাচনে আয়ারল্যান্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জনকারী দলকে বোঝায়। প্রথমে প্রতিষ্ঠিত এই আইআরএ-কে একই নামের অন্যান্য আর্মি থেকে পৃথক করার জন্য অনেক সময়ই ওল্ড আইআরএ নামে ডাকা হয়।
আয়ারল্যান্ডে একটি সবল বাণিজ্য-নির্ভর অর্থনীতি বিদ্যমান। ১৯৯৫-২০০০ অর্থবছরগুলিতে এর প্রবৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ১০ শতাংশ। কৃষি একসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল। তবে বর্তমানে শিল্পখাত অধিক গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপির ৪৮% এবং রপ্তানির ৮০% শিল্পখাত থেকে আসে। শ্রমশক্তির ২৯% শিল্পখাতে নিয়োজিত।
আয়ারল্যান্ড বর্তমানে অনেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রবাসী বাস করেন। প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশীদের গোড়াপত্তন হয় ১৯৭০ এর দশকে। সেই তথ্য অনুযায়ী মরহুম জনাব ইউনুস প্রথম বাংলাদেশী যিনি আয়ারল্যান্ডে এসেছিলেন জীবন জীবিকার অন্বেষনে। তার পরিবার এখনো কেভান শহরে বসবাস করছেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বহু বাংলাদেশি আয়ারল্যান্ডে এসেছেন এবং এখনো এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
অনেকেই দেশ থেকে অধ্যয়ন ভিসা নিয়ে অথবা তৃতীয় কোন থেকে কিংবা বাংলাদেশ থেকে চাকরি ভিসা, ভ্রমণ ভিসা, স্বল্পকালীন অবকাশ ভিসা নিয়ে এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন। আবার অনেকেই স্পাউস বা নির্ভরশীল ভিসায় আসেন। আর কিছু নানা উপায়ে অনিবন্ধিত অবস্থায় আয়ারল্যান্ডে আসেন। আয়ারল্যান্ডে এই মুহূর্তে কতজন প্রবাসী বাংলাদেশী আছেন সেই ব্যাপারে এই মুহূর্তে আমাদের হাতে সঠিক কোন তথ্য নেই।
বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশীদের তৃতীয় জেনারেশন চলছে। যদিও তৃতীয় জেনারেশনের বংশধর এখনো তাদের বাল্যকালে অবস্থান করছে। কিন্তু দ্বিতীয় জেনারেশনেরই কেউ কেউ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করা শুরু করেছে। আয়ারল্যান্ডকে সাপ বিহীন দেশও বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে কিছু শৌখিন ব্যক্তির সংগ্রহে বা চিড়িয়াখানায় অবশ্যই অল্প কিছু সাপ আছে, কিন্তু পুরো আয়ারল্যান্ডের বনে-জঙ্গলে কোথাও কোনো সাপ নেই।
আইরিশ রূপকথা অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ডে সাপ না থাকার কারণ হচ্ছে, সেইন্ট প্যাট্রিক নামের এক ধর্মপ্রচারক মন্ত্রের জোরে সব সাপকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি নাকি সাপের হাত থেকে আয়ারল্যান্ডকে মুক্ত করেছিলেন। বাস্তবে এই ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের মতে, সেইন্ট প্যাট্রিকের পক্ষে সাপ নির্বাসিত করা সম্ভবই ছিল না। কারণ আয়ারল্যান্ডে কোনোকালেই সাপ ছিল না।
ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আয়ারল্যান্ডের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক নাইজেল মোনাগান জানান, আয়ারল্যান্ডে কখনোই কোনো সাপের ফসিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এ অঞ্চলে কোনো সাপ ছিল না। বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি সাপ আছে। তবে আয়ারল্যান্ডে কেন সাপ নেই? এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, আয়ারল্যান্ড একটি দ্বীপ ও শীতল দেশ।
তাছাড়াও কাছাকাছি স্থলভূমির সঙ্গে আইরিশ সমুদ্রের উপর দিয়ে এর দূরত্ব সর্বনিম্ন ৭০ কিলোমিটার। কোনো সাপের পক্ষে এতো দূরের পথ সাঁতরে পাড়ি দেয়া সম্ভব না।
কবির আহমেদ, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট