নিশীথ সূর্যের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নরওয়ে

নরওয়ে ভৌগলিকভাবে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের দেশ বলে মাঝরাতেও আকাশে সূর্যের আলো থাকে

 কবির আহমেদ, ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়াঃ মধ্যরাতের সূর্যের দেশ বলা হয় নরওয়েকে। মধ্যরাত সূর্য একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যা গ্রীষ্মের মাসগুলিতে আর্কটিক সার্কেলের উত্তরে বা অ্যান্টার্কটিক সার্কেলের দক্ষিণে কিছু জায়গায় ঘটে যখন স্থানীয় মধ্যরাতে সূর্য দৃশ্যমান থাকে।

নরওয়েকে মধ্যরাতের সূর্যের দেশ বলার কারণ,দেশটি অতি উচ্চতায় ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে অবস্থিত হবার ফলে সেখানে দীর্ঘ ঋতু ধরে দিবালোকের মত রাতেও সূর্যের আলো দেখা যায়। এই দেশে মে থেকে জুনে একটানা ৭৬ দিন পর্যন্ত সূর্য কখনও অস্ত যায় না। তবে ২০ ঘণ্টা সূর্যের আলো অনেক বেশী থাকে। বাকি ৪ ঘণ্টা সূর্য কিছুটা নিমজ্জিত অবস্থায় থাকে, তবে সম্পূর্ণ অস্ত যায় না।

“মধ্যরাতের সূর্যের দেশ” হিসেবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ নরওয়ে অঞ্চল বিশ্ব-পরিচিত। এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে “মধ্যরাতের সূর্য” আসলে কি ? “মধ্যরাতের সূর্য” হল একটি প্রাকৃতিক কারণ বা ঘটনা যার ফলে গ্রীষ্মকালে সূর্য অস্ত হয় না। অর্থাৎ দিন-রাত্রির ২৪ ঘণ্টাই সূর্যকে দেখতে পাওয়া যায়।

নরওয়েতে অনেক সময় সেখানে দিনের পর দিন সূর্যের দেখাই মেলে না। এই অঞ্চলের মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত সময়টিতে সূর্য কখনো সম্পূর্ণ অস্তমিত হয় না। এঁর ফলে এই সময়টিতে রাত্রের অন্ধকারের পরিবর্তে গোধূলির ম্লান আলো রাত্রি জুড়ে বিরাজমান থাকে। তবে প্রকৃত মধ্যরাতের সূর্য দেখা যায় ২১ জুন। আর এই জন্যই নরওয়েতে বসবাসকারী মুসলিমদের রোজার মাসে প্রতিবেশী সুইডেনের সময়সূচী অনুসরণ করতে দেখা যায়।

নরওয়ে অঞ্চলের উত্তরাংশে দুমাস ধরে সূর্য কখনই সম্পূর্ণ অস্ত যায় না। কিন্তু শীতের দুমাস আবার সূর্য ওঠেই না। আর তখন প্রায়ই উত্তরের আলো বা ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ দেখা যায়। নরওয়ের ট্রামসো শহর সহ বিভিন্ন শহরে মে মাসের শেষ থেকে জুলাই পর্যন্ত সূর্য কখনই দিগন্তের নীচে পুরোপুরি অস্ত যায় না। এই মাসগুলিতে ট্রমসো শহরে বসবাসকারী লোকেরা মধ্যরাতের রোদ উপভোগ করে।

পৃথিবী যেহেতু নিজ অক্ষে একটু কাত হয়ে ঘুরছে তাই বছরের অর্ধেক সময় সূর্য উত্তর গোলার্ধে বেশি আলো দেয়, মানে তখন উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল থাকে। এই পুরোটা সময়ে উত্তর মেরুতে দিন থাকে। তখন সূর্য ওঠানামা করে শুধু, পুরোপুরি ডুবে যায়না। একই ঘটনা দক্ষিণ মেরুতে ঘটে যখন সেখানে গ্রীষ্মকাল শুরু হয় এবং উত্তরে শুরু হয় শীতকাল। শীতের পুরোটা সময় দুই মেরুই সূর্যের আলোবিহীন কাটায়।

নরওয়ে উত্তর ইউরোপের একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার সরকারি নাম নরওয়ে রাজ্য। এই দেশটির রাজধানী শহরের নাম অসলো (নরওয়েজীয় উচ্চারণ Oslo উষ্‌লু)। নরওয়ের পূর্বে সুইডেন, দক্ষিণে ফিনল্যান্ড ও পশ্চিমে রাশিয়া অবস্থিত। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর ও ব্যারেন্টস সাগরের নরওয়ের জলসীমা আছে।

নরওয়েতে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রচলিত। নরওয়ের আয়তন ৩,৮৫,২৫২ বর্গ কিলোমিটার। ২০১৮ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী নরওয়ের জনসংখ্যা প্রায় ৫৪ লক্ষ। নরওয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন জনঘনত্ববিশিষ্ট রাষ্ট্র। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে মাত্র প্রায় ১৭ জন মানুষ বাস করেন।রাজধানী অসলো দেশটির বৃহত্তম নগরী বা বসতি।

নরওয়ের সরকারি ভাষা নরওয়েজীয় (Bokmål ও Nynorsk)। নরওয়ে ১৮১৪ সালের ১৭ মে সুইডেন ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটির বার্ষিক জিডিপি (পিপিপি) আনুমানিক প্রায় ৩৭৭,১ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৭০,৬৬৫ ডলার।নরওয়ের মুদ্রার নাম নরওয়েজীয় ক্রোন (NOK)।নরওয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের(EU) সদস্য না। দেশটির জনগণ ইইউতে যাবার গণভোটে না ভোট দিয়েছিল।

নরওয়ে ও সুইডেনকে একত্রে স্ক্যান্ডিনেভিয়া বলা হয়। এটি পৃথিবীর ধনীতম এবং শান্তিতম দেশের একটি। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে  নরওয়ে পৃথিবীর প্রথম ধনী দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। ২০,০০০ কিলোমিটার তটরেখার সমৃদ্ধ নরওয়ের জোস্টেডলসব্রিন উত্তর ইউরোপের বৃহত্তম হিমবাহ এবং এখানে ৪,৫০,০০০টি হ্রদ রয়েছে। তন্মধ্যে ২০০টির আয়তন ৪ বর্গমাইল বা ততোধিক। নরওয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশের অন্যতম হলেও এখানে গ্যাসের দাম পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। নরওয়ের ২৪.৫ কিলোমিটার বা ১৫ মাইল দীর্ঘ লেরাডাল রোড ট্যানেল পৃথিবীর দীর্ঘতম রোড ট্যানেল। ২৮৭ মিটার গভীর পৃথিবীর দীর্ঘতম জলগর্ভস্থ ট্যানেলও নরওয়েতে অবস্থিত।

নরওয়ে বছরের আট মাস বরফের নিচে ঢাকা থাকে। বছরের দুই মাস এখানে সূর্য ওঠে না। নভেম্বরের ২১ তারিখ থেকে জানুয়ারির ২১ তারিখ পর্যন্ত সময়টাকে তাই ডার্ক পিরিয়ড বলা হয়। এই সময় আকাশে নর্দার্ন লাইট বা অরোরা বুরিয়াল দেখা যায়। আকাশে লাল, সবুজ রঙের আলোর খেলা। এই অরোরা দেখতে অনেক পর্যটক এই সময়ে এখানে আসেন।

অনেক প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ নরওয়ে। নরওয়েতে রয়েছে প্রাকৃতিক তেল এবং গ্যাসের বিশাল মজুদ।গ্যাস উৎপাদন নরওয়ের – অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের বড় মজুদ রয়েছে দেশটির উত্তর সাগরে (North Sea)। তাছাড়াও দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে আরও আছে লৌহ, আকরিক,কয়লা ও মৎস্য সম্পদ।

মৎস্য আহরণ ও  প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে নরওয়ে বিশ্বের অন্যতম একটি দেশ। প্রাকৃতিক তেল,গ্যাস ও অন্যান্য সম্পদের মতই মৎস্য উৎপাদন দেশটির অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। নরওয়ের মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রধান কেন্দ্র – বার্গেন স্টাভাঙ্গার, Trondheim,, Alesund এ অবস্থিত। রাশিয়া সহ সমগ্র ইউরোপে নরওয়ের “নর্থ সী” এর বিভিন্ন রকমের মাছ বেশ সমাদৃত।

বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দেশ নরওয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশটির পরিবেশ ও জীবনধারা যথেষ্ট শিক্ষাবান্ধব। উঁচু মানের গবেষণা, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং নানা সুযোগ সুবিধার জন্য বিখ্যাত নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

নরওয়ের শিক্ষাব্যবস্থা কখনো কোনো শিক্ষার্থীকে হতাশ করবে না। তবে, দেশটিতে মানিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের জানতে হবে বেশকিছু বিষয়। নরওয়ে একটি ব্যয়বহুল দেশ। দেশটিতে বাসস্থান ও চলাফেরার জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। তাই, পকেটে যথেষ্ট অর্থ না থাকলে সেখানে টিকে থাকা একটু কঠিন। যে কারণে, সীমিত বাজেটধারী শিক্ষার্থীদের সেখানে স্কলারশীপের আবেদন করার পরামর্শ দেয়া হয়। সেখানকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষার্থীদের স্কলারশীপ দিয়ে থাকে।

কবির আহমেদ, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

EuroBanglaTimes

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »