কবির আহমেদ, ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়াঃ জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের এক দেশ রাশিয়া। জাতিসংঘের যে কোন প্রস্তাব বা পরিকল্পনায় স্থায়ী সদস্যের একজন ভেটো দিলে বা না বললে সেটি বাতিল হয়ে যায়।
রাশিয়ার ভৌগলিক অবস্থান: রাশিয়া ভৌগলিকভাবে ইউরোপ মহাদেশের একটি দেশ। রাশিয়া এক সময়ের বৃহত্তম সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরও বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড় দেশ। এক সময় বলা হত সোভিয়েত ইউনিয়ন অফ রাশিয়ার যখন একপ্রান্তে সকাল তখন অন্য প্রান্তে সন্ধ্যা। বর্তমানে রাশিয়া সরকারিভাবে রুশ ফেডারেশন নামে পরিচিত।
রাশিয়া পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম দেশ। এই দেশটি অর্ধ প্রেসিডেনসিয়াল ফেডারেল প্রজাতন্ত্র যার সংবিধান ৮৩ টি ফেডারেল বিষয় দ্বারা গঠিত। রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব পর্যন্ত নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ড (উভয় দেশই কালিনিনগ্রাদ অব্লাস্ত সীমান্ত দিয়ে যুক্ত), বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, চীন, মঙ্গোলিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সাথে সীমান্ত আছে।
দেশটির অখতস্ক সাগরের মাধ্যমে জাপানের সাথে ও বেরিং প্রণালীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার সাথে সামুদ্রিক সীমানা রয়েছে। রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দেশ যার রয়েছে পৃথিবীর মোট আবাসযোগ্য জমির এক অষ্টমাংশ। দেশটির মোট আয়তন ১৭,০৭৫,৪০০ বর্গকিলোমিটার (৬,৫৯২,৮০০ বর্গমাইল)। রাশিয়া বিশ্বের নবম জনবহুল দেশ যেখানে ২০১২ হিসাব অনুযায়ী ১৪৩ মিলিয়ন (প্রায় ১৪ কোটি ৩০ লাখ) লোক বসবাস করে। পূর্ব ইউরোপে জায়গা সম্প্রসারণের ফলে রাশিয়া ১১টি সময় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত এবং এখানে অনেক রকম ও বিস্তৃত পরিবেশের সমন্বয় ঘটেছে।
রাশিয়ার রাজধানীর নাম মস্কো এবং এটি দেশটির বৃহত্তম নগরী ও সবচেয়ে বেশী বসতির শহর। দেশটির সরকারি ভাষা রুশ। বর্তমানে বৃহত্তর এই দেশে স্বীকৃত ভাষা ৩৫ টি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর (২০১০) মধ্যে ৮১.০% রুশ,৩.৭% তাঁতার ১.৪% ইউক্রেনি, ১.১% বাশকির,১.০% চুভাশ ০.৮% চেচেন এবং ১১.০% অন্যান্য।
দেশটির বার্ষিক জিডিপি (পিপিপি) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক $৩.৪৫৮ ট্রিলিয়ন ডলার।আর মাথাপিছু বার্ষিক আয় $২৪,০৬৭ ডলার। রাশিয়ার মুদ্রার নাম রুশ রুবল (RUB)।
ভলগা নদী: রাশিয়ার ভলগা নদী (ইংরেজি: Volga River; রুশ: Волга) দৈর্ঘ্য, প্রবাহ এবং অববাহিকার দিক থেকে ইউরোপের বৃহত্তম নদী। নদীটি মধ্য রাশিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একে রাশিয়ার জাতীয় নদী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মস্কোসহ রাশিয়ার বৃহত্তম এগারটি শহর ভলগার অববাহিকায় অবস্থিত। বিশ্বের বৃহত্তম জলাধারগুলোর অধিকাংশই এই অঞ্চলে পাওয়া যায়। রুশ সংস্কৃতির এক অনবদ্য অংশ এই নদী। রাশিয়ান সাহিত্য ও রূপকথায় ভলগাকে ‘ভলগা মাতুস্কা’ বা ভলগা মা বলে আখ্যায়িত করা হয়।ভলগা নদীর দৈর্ঘ্য ৩,৬৯২ কিলোমিটার এবং এর অববাহিকা ১৩,৮০,০০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ: রাশিয়ার ট্রান্স সাইবেরিয়ান বিশ্বের দীর্ঘতম রেলপথ।ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে একটি রেলপথ ব্যবস্থা যা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোকে দেশটির পূর্বাঞ্চল তথা সাইবেরিয়ার সাথে যুক্ত করেছে। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম রেলপথ। মঙ্গোলিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়ায় এই রেলপথের সংযোগকারী শাখা আছে। ১৯১৬ সাল থেকে এটি মস্কোকে ভ্লাদিভস্তকের সাথে যুক্ত করেছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো রেলপথ। পৃথিবীর এই দীর্ঘতম রেলপথটির দৈর্ঘ্য ৯,৯৩২ কিলোমিটার।
রাশিয়ার ইতিহাস: রাশিয়ার ইতিহাস শুরু হয় পূর্ব স্লাভ ও ফিনো-উগ্রিক জাতির বিকাশের মধ্য দিয়ে। প্রথাগত রুশ ইতিহাস শুরু হয় ৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সমন্বিত পূর্ব স্লাভীয় রাষ্ট্র, কিয়েভান রুস, প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রটি ৯৮৮ সালে বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্য হতে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে, যার ফলে বাইজেন্টীয় ও স্লাভীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন শুরু হয় যা পরবর্তী সহস্রাব্দ পর্যন্ত গোঁড়া স্লাভীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। কিয়েভান রুশ ১২৩৭ থেকে ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে বিভক্ত হতে শুরু করে এবং এই আক্রমণগুলোতে রুসের প্রায় অর্ধেক জনগণ মারা যায়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর মস্কো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাশিয়ার জারতন্ত্র বিকাশ লাভ করে রুশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়, যা পূর্ব পোল্যান্ড থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সে সময় প্রায়ই কৃষক বিদ্রোহ লেগে থাকতো এবং সবগুলো বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করা হয়। রুশ সের্ফতন্ত্র ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে বিলুপ্ত হয়, কিন্তু কৃষকেরা অল্প কর পরিশোধ করত এবং বিল্পবী চাপ প্রদান করত। পরবর্তী দশকগুলোতে সংস্কারের প্রচেষ্টা, যেমন স্তোলপিন সংস্কার, ১৯০৬ সালের সংবিধান ও স্টেট দুমা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মুক্ত ও স্বাধীন করার চেষ্টা করে, কিন্তু জারগণ তাদের স্বৈরশাসন ত্যাগ বা তাদের ক্ষমতা বণ্টন করতে নারাজ ছিলেন।
রাশিয়ার প্রাক-ইতিহাস সম্পাদনা: ২০০৬ সালে উত্তর ককেশাসের দাগেস্তান আকুশা অঞ্চল থেকে ১.৫ মিলিয়ন বছর পুরনো ওল্ডোয়ান ফ্লিন্টের সরঞ্জাম আবিস্কৃত হয়, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে প্রারম্ভিক সময় থেকেই রাশিয়ায় মানব বিচরণ ছিল।ইউরোপের কোন স্থান থেকে প্রাপ্ত আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের প্রথম প্রমাণ মিলে ২০০৭ সালে রাশিয়ার ডন নদীর নিকটবর্তী কস্তেন্কি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের গভীরতম স্তর থেকে, যা ৪০,০০০ বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়।
৪০,০০০ বছর পূর্বে আর্কটিক রাশিয়ায় মানুষ পৌঁছেছিল। আদিগিয়ার মেজমাইস্কায়া গুহায় নিন্দার্টাল শিশুদের আংশিক কঙ্কাল আবিস্কারের পর প্রকাশিত হয় যে আর্কটিক রাশিয়া ছিল সর্বশেষ নিন্দার্টালদের নিবাস, কার্বন তারিখ গণনা অনুসারে তা ২৯,০০০ বছর পুরনো। ২০০৮ সালে নভসিবির্স্কের ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজি অ্যান্ড এথনোলজির রুশ প্রত্নতত্ত্ববিদগণ সাইবেরিয়ার আল্টাই পর্বতমালার দেনিসভা গুহায় অনুসন্ধান চালিয়ে ৪০,০০০ বছর পুরনো একটি শিশু হোমিনিনের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের হাড় আবিষ্কার করে। এর ডিএনএ বিশ্লেষণ করার পর প্রকাশিত হয় যে এটা মানুষের অজ্ঞাত কোন প্রজাতির, যার নাম দেওয়া হয় দেনিসভা হোমিনিন।
খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে গ্রিক বণিকের তানাইস ও ফানাগোরিয়ায় বাণিজ্য সম্ভারের পাশাপাশি ধ্রুপদী সভ্যতার ছোঁয়া এনে দেয়। হেরোডটাস খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে হেলনি ও বুদিনিদের তৈরি গেলোনাসকে বৃহৎ (ইউরোপের সর্ববৃহৎ) মাটি ও কাট দিয়ে নির্মিত বসতি বলে উল্লেখ করেন। ৬৩ থেকে ৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট নিরোর অধীনস্থ বসপরান রাজ্য ছিল রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশ মোয়েসিয়ার অংশ। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে গথরা কৃষ্ণ সাগরের তীরে অভিবাসিত হয় এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে দক্ষিণ রাশিয়ায় অর্ধ-কিংবদন্তিতুল্য গথিক রাজ্য বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীকালে হুন জাতি তাদের পরাজিত করে। তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে বসপরান রাজ্য গ্রিক উপনিবেশগুলো দখল করে[৮] এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানো যুদ্ধরত যাযাবরদের আক্রমণের ফলে বিপর্যস্ত হয়।
প্রারম্ভিক পূর্ব স্লাভ সম্পাদনা: আধুনিক রুশদের কিছু পূর্বপুরুষেরা ছিলেন স্লাভ উপজাতির। অনেক পণ্ডিতবৃন্দ তাদের মূল আবাসভূমি প্রিপেত মার্সেসের বনাঞ্চল বলে ধারণা করেন। প্রারম্ভিক পূর্ব স্লাভরা ধীরে ধীরে পূর্ব রাশিয়ায় বসতি স্থাপন করতে শুরু করে, মূলত দুটি প্রবাহের মধ্য দিয়ে: প্রথমটি কিয়েভ থেকে বর্তমান সময়ের সুজদাল ও মুরমের দিকে এবং অপরটি পোলতস্ক থেকে নভগরদ ও রুস্তভের দিকে যেতে শুরু করে।
রুশ বিপ্লব: ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জারতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে রাজধানী পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) একটি ফ্যাক্টরিতে ধর্মঘট ডাকা হয়। ১৯১৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি হাজার হাজার নারী পোশাক-শিল্প কর্মী খাদ্যাভাবের জন্য তাদের ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে আসেন এবং অন্যদেরও তাদের সাথে যোগ দিতে বলেন। কয়েকদিনের মধ্যে শহরের প্রায় সকল শ্রমিকেরা কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং রাস্তার তাদের মধ্যে মারাপিঠ শুরু হয়ে যায়। জার ধর্মঘট পালনকারীদের কাজে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয় এবং সৈন্যদের নির্দেশ দেয় যেন তারা রাস্তায় আন্দোলনকারীদের গুলি করে। তার আদেশ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়, বিশেষ করে যখন সৈন্যরা প্রকাশ্যে ধর্মঘট পালনকারীদের পক্ষ নেয়। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের পদচ্যুত করার মধ্য দিয়ে ২রা মার্চ জার ও অভিজাততন্ত্রের পতন হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯২২-১৯৯১) প্রতিষ্ঠা: রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস ১৯২২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। সেই সময়ে নতুন দেশটিতে চারটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র যুক্ত হয়, সেগুলো হল রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, বেলারুশীয় সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক এবং ট্রান্সককেশীয় সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক।
১৯৯১ সালে ভেঙ্গে যাবার আগ পর্যন্ত সোভিয়েত ঐক্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ১৫টি নতুন প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়।সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যে ১৫ টি দেশ হয়েছে, সেগুলি যথাক্রমে রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া,লিথুনিয়া,আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, মোল্দাভিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং জর্জিয়া।
কবির আহমেদ, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট