কবির আহমেদ, ভিয়েনা, অষ্ট্রিয়াঃ লিশটেনস্টাইন(জার্মানি উচ্চারণ লিকটেনষ্টাইন) মধ্য ইউরোপের একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র । এটি পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অন্যতম একটি দেশ।দেশটির মোট আয়তন মাত্র ১৬০ বর্গকিলোমিটার। ভাদুজ শহর(Vaduz,জার্মানি উচ্চারণ ফাডুৎস) দেশটির রাজধানী এবং শান দেশটির বৃহত্তম নগরী। ছোট এই দেশটির সরকারি ভাষা জার্মানি এবং দেশটিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র সরকার প্রতিষ্ঠিত আছে।
২০১৮ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা ৩৮,১৪৬ জন।দেশটির জিডিপি (মনোনীত) $৩.৪৮২ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু বাৎসরিক আয় $১০০,৮৬০ ডলার। লিশটেনস্টাইনের মুদ্রার নাম সুইস ফ্রঁ (CHF)।
মধ্য ইউরোপের ছোট এই দেশটির অবস্থান মোটামুটি ত্রিভুজাকৃতির ছবির মত সুন্দর এই রাষ্ট্রটি ইউরোপের বিখ্যাত আল্পস পর্বতমালার অভ্যন্তরে রাইন নদীর উপত্যকার একটি অংশে অবস্থিত। ছোট্ট এই স্থলবেষ্টিত দেশটির উত্তরে ও পূর্বে অস্ট্রিয়া, এবং পশ্চিমে ও দক্ষিণে সুইজারল্যান্ড। সুইজারল্যান্ডের সাথে লিশটেনস্টাইনের পশ্চিম সীমান্তের পুরোটাই রাইন নদী দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চলে উপত্যকাটি সরু হলেও উত্তরে এটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়ে উর্বর নিম্নভূমিতে পরিণত হয়েছে। লিশটেনস্টাইনের প্রায় ৪০% এলাকা রাইন উপত্যকা নিয়ে গঠিত, বাকিটা পর্বতময়। উত্তরের অংশ ওবারলান্ড এবং দক্ষিণের অংশ উন্টারলান্ড নামে পরিচিত।
লিশটেনস্টাইন একটি রাজপুত্র-রাজ্য (Principality of Liechtenstein) অর্থাৎ একজন রাজপুত্র এলাকাটি শাসন করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডের মত লিশটেনস্টাইনও একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। রাজ্যটি ১৭১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮০৬ সালের ৬ই আগস্ট এটি স্বাধীনতা লাভ করে। উনিশ শতকে এর অর্থনীতি অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। ১৯১৮ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির পতন ঘটলে লিশটেনস্টাইন সুইজারল্যান্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
১৯২১ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় ও জাতীয় মুদ্রা হিসেবে সুইস ফ্রঁ-কে গ্রহণ করা হয়। ১৯২৪ সালে দেশটি সুইজারল্যান্ডের সাথে একটি শুল্ক, অর্থনৈতিক ও মুদ্রা ইউনিয়ন গঠন করে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উন্মুক্ত। সুইস কর্মকর্তারাই অস্ট্রিয়ার সাথে লিশটেনস্টাইনের সীমান্ত রক্ষা করেন এবং বিদেশে লিশটেনস্টাইনের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৮৬৮ সাল থেকে লিশটেনস্টাইনের কোন সামরিক বাহিনী নেই। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও লিশটেনস্টাইন ছিল মূলত কৃষকদের একটি জাতি। দেশের সর্বত্র ছোট ছোট গ্রাম ও কৃষি খামার ছড়িয়ে আছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর রাজপুত্র ২য় ফ্রান্সিস জোজেফ-এর অধীনে লিশটেনস্টাইন অত্যন্ত কর্মচঞ্চল অর্থনৈতিক সেবা খাতবিশিষ্ট একটি শিল্পোন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। করের হার নিম্ন বলে এবং কর্পোরেশনগুলির তদারকি আইন শিথিল বলে এখানে দেশ বিদেশের ৭৫ হাজারেরও বেশি কোম্পানি অফিস খুলেছে, যা লিশটেনস্টাইনের মোট জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। লিশটেনস্টাইনের বহু ব্যাংক বিদেশী কোম্পানির জন্য বাণিজ্যিক সেবা প্রদান করে থাকে। দেশটি ইউরোপীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অংশীদার (সুইজারল্যান্ডের সাথে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্যনীয়) এবং বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র জার্মানভাষী রাষ্ট্র। ২য় হান্স-আডাম বর্তমানে দেশটির নেতা।
লিশটেনস্টাইনের কারুকার্যময় ও প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত ডাকটিকেট বিশ্ববিখ্যাত। পর্যটকেরা এগুলি সংগ্রহ করতে ভালবাসেন এবং এগুলি লিশটেনস্টাইনের জাতীয় আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
ছোট হলেও দেশটির রয়েছে বেশ প্রাচীন ইতিহাস। দেশটির রাজধানী ভাদুজের প্রাচীন নাম ছিল ফার্দুজেস। ১৩২২ সালে গড়ে ওঠে ভার্দুজ দুর্গ। ১৩৪২ সালে ওয়েরডেনবার্গ প্রদেশের শাসকদের হাতে এই দেশের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৪৯৯ সালের দিকে সোয়াবিয়ার যুদ্ধে সুইস রাজারা ভাদুজ আক্রমণ করে দখল করে। ১৭ শতকের দিকে লিশটেনস্টাইনের বর্তমান শাসক পরিবাররা ভাদুজে আসেন। পরবর্তীকালে যুবরাজ জোহান অ্যাডাম আনড্রিয়াস সেলেনবার্গ এবং ভাদুজকে একত্র করে ১৭১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে লিশটেনস্টাইনকে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু ১৭১৯ সালে রোমান সম্রাটরা নিজেদের অধীনে এই অঞ্চলের শাসনভার তুলে নেন। প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি শাসন করার পর ১৮০৬ সালে দেশটিকে পরিপূর্ণ স্বাধীন ঘোষণা করা হয়।
১৯৩৮ সাল থেকে রাজা ভাদুজ দুর্গকে পাকাপাকি বাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলে। যুবরাজ ফ্রান্স জোসেফ (দ্বিতীয়) ছিলেন এই দুর্গের প্রথম বাসিন্দা। তার আমল থেকেই এই দুর্গে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তার মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে রাজপুত্র হান্স অ্যাডাম (দ্বিতীয়) এই দেশের শাসনভার তুলে নেন। রাজার অধীনে দেশটির পার্লামেন্ট চলে, যেখানে ২৫ জন মন্ত্রী বা সংসদীয় সদস্য রয়েছে যাদের মেয়াদ চার বছর পর্যন্ত। এছাড়াও দেশটির ১১টি পৌরসভা জুড়ে প্রায় ৬০০টির মতো ক্লাব রয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের মতো এই দেশেরও নিজস্ব কোনো সামরিক শক্তি নেই। দেশটির নিরাপত্তা অবস্থা বিচার করে ১৮৬৮ সালের পর থেকে সেনাবাহিনী পুরোপুরিভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়। তবে সেনাবাহিনী না রাখার ব্যাপারে মূলত অর্থনৈতিক দিকটাই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করা, পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্র কেনা বেশ ব্যয়বহুল। সেই কারণে দেশটি থেকে সেনাবাহিনী পুরোপুরি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশটির সার্বিক আইনশৃঙ্খলার তত্ত্বাবধানে কেবল ‘ন্যাশনাল পুলিশ প্রিন্সিপালিটি’ নামে একটি পুলিশ বাহিনী রয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও যেকোনো ধরনের নিরাপত্তাজনিত সাহায্য সহযোগিতা সুইজারল্যান্ড দিয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়।
১৫ আগস্টকে দেশটিতে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি মূলত পুরো দেশের আনন্দ উৎসবের দিন। দুর্গের প্রাঙ্গনে দেশবাসীরা একত্র হয়। দুর্গের সামনেই বসে মেলা এবং ভিন্ন ধরনের নাচ-গানের আসর। এছাড়াও সন্ধ্যেবেলা দুর্গের মাঠে আতশবাজির প্রদর্শন হয়। রাজার পক্ষ থেকে সবাইকে ওয়াইন পরিবেশন করা হয়। সকল অতিথিদের আনন্দ উৎসবে রাজাও সামিল হন।
লিশটেনস্টাইনের বর্তমান রাজার পুরো নাম জোহানেস অ্যাডাম ফার্দিনান্দ আলোয়াস জোসেফ মারিয়া মার্কো ডিভিও পাইওস বা সংক্ষেপে হান্স অ্যাডাম (দ্বিতীয়)। তার জন্ম হয় ১৯৪৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। তার পিতা ফ্রান্স জোসেফ (দ্বিতীয়) ১৯০৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত লিশটেনস্টাইন শাসন করেন। তার মায়ের নাম হলো কাউন্টেস জর্জিনা ভন উইলকজার। হান্স অ্যাডামের জ্যেষ্ঠ পুত্র এলয়েস ফিলিপ মারিও হবেন পরবর্তী যুবরাজ।
আল্পস পর্বতমালার উপর অবস্থিত বলে লিশটেনস্টাইন মূলত একটি শীতপ্রধান দেশ। শীতের সময় খুব ঘন ঘন তুষারপাত হয় এখানে। বরফে ঢেকে যায় পাহাড়ি সব উপত্যকা আর গাছগাছালি। গ্রীষ্মকালে হালকা ঠাণ্ডা এবং মাঝারি উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। ফলে শীত ও গ্রীষ্ম উভয় সময়েই এখানকার অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে থাকে।
এই দেশে ভ্রমণের জন্য সেনজেন ভিসা নিয়েই এই প্রবেশ করা যায়। সুইজারল্যান্ডের মতোই এই দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বেশ উন্নত। ছোট্ট দেশটিতে প্রায় ১৫টি ব্যাংক রয়েছে। দেশটির মোট জিডিপি’র এক-চতুর্থাংশ আসে এই ব্যাংকিং খাত থেকে। এর মধ্যে বহু ব্যাংক বিদেশী কোম্পানির বাণিজ্যিক সেবাও প্রদান করে থাকে। এছাড়াও কৃত্রিম দাঁত তৈরি এবং সংস্থাপনে লিশটেনস্টাইন প্রথম অবস্থান ধরে রেখেছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িকভাবেও দেশটির বেশ গুরুত্ব রয়েছে। সুইজারল্যান্ড থেকে মাত্র ৪১.১ কিমি এবং অস্ট্রিয়া থেকে মাত্র ৩৪.৯ কিমি দূরত্বে দেশটির অবস্থান। দেশটির মধ্যে ৩০টিরও বেশি বড় বড় কোম্পানি রয়েছে যাতে প্রায় ৮,০০০ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণায় দেশটির উন্নতি দৃশ্যমান। দেশটিতে চারটি গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নয়টি উচ্চবিদ্যালয় রয়েছে।
লিশটেনস্টাইনের নিজস্ব কোনো বিমানবন্দর নেই। তবে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে সুইজারল্যান্ড এবং ৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে জার্মানির এয়ারপোর্ট। লিশটেনস্টাইনের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত। এখানে রয়েছে ব্যাটারিচালিত সিটি ট্রয় ট্রেন। দু’কামরার এই ট্রেনে করে ঘুরে আসা যায় ভাদুজের পুরনো শহর, প্রান্তর বিস্তৃত আঙুরক্ষেত, প্যানোরোমা ভিউ পয়েন্ট, রাইন পার্ক স্টেডিয়াম, ভাদুজ সিটি সেন্টার আরো কত কী! এছাড়াও এখানে বেশ ভালো বাস পরিবহন সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জন্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্সি সুবিধা।
রাজধানী ভাদুজ থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে লিশটেনস্টাইনের দক্ষিণ-পূর্বে আল্পস পর্বতের দক্ষিণ গিরিশিরায় গড়ে উঠেছে অনন্য সুন্দর এক গ্রাম মালবুন। এখান থেকে চারপাশে বহু হিমশৃঙ্গের দেখা মেলে। ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম, যেখানে রয়েছে ১৯৫০ সালে নির্মিত চ্যাপেল অফ পিস। মালবুনের পাহাড়ে বা উপত্যকায় শীতের সময় বরফ জমে গেলে স্নো-বোর্ডিং, হাইকিং, বাইকিং আর স্কিয়িংয়ের জমজমাট আসর বসে। এখান থেকেই ২ কিলোমিটার দূরে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত। এছাড়াও সোলেনবার্গ ও ট্রাইসেনবার্গ পাহাড়ি ও পুরনো জনপদগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কবির আহমেদ, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট