ঢাকা: আকাশে গোলাপি আভা ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর নিস্তব্ধতা নেমে আসে হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে। দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই, রমজান মাসের শেষ দিকে।
রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। পাঁচ বছর আগে এই দিনে নব্য জেএমবির পাঁচ জঙ্গি বেকারিতে ঢুকে প্রথমে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া রাতভর জিম্মি করে রাখে বেকারিতে আসা বেশ কয়েকজন অতিথি ও বেকারির স্টাফদের।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিযে পার হওয়া সেই রাত শেষে ভোরে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিটের নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাব যৌথভাবে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ নামে অভিযান চালায়। ওই অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। উদ্ধার করা হয় হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি অবস্থায় থাকা দেশি-বিদেশি অতিথি ও বেকারির স্টাফসহ প্রায় ৩৫ জনকে।
হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর উপলক্ষে বুধবার (১ জুলাই) সকাল ৭টা থেকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর প্লটের ওই বাড়িটি নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য খুলে দেওয়া হবে। গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোফাজ্জল হোসেন জানান, করোনা মহামারির কারণে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও সীমিত পরিসরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি নাগরিকদের জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সেখানে বেশি মানুষের ভিড় করতে দেওয়া হবে না।
জামিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) একটি অংশ ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে নব্য জেএমবি নামে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে এই হামলা চালায়।
এই ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে বেশকিছু জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে। এরপর তারা হোলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হন।
তামিম ২০১৩ সালে দেশে ফেরার আগে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন এবং ২০১৫ সালে আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন। সে বছরের ১১ জুলাই তার দলটি মূলধারার জেএমবি সারওয়ার জাহান মানিকের দলে যোগ দেন।
সারওয়ার জাহানকে বাংলার আমির ঘোষণা করা হয় এবং তার নাম হয় আবু হানিফ-আল বাঙালি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতে এই দলটি পরে ‘নব্য জেএমবি’ নাম ধারণ করে স্থানীয়ভাবে আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সারওয়ারও শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ এই হামলার দুই বছরের মাথায় ২১ জনের সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণ পেয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় মামলার তদন্ত সংস্থা-কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তবে ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন অপারেশন থান্ডারবোল্টসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য অভিযানে মারা যাওয়ায় জীবিত ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল এই মামলার যুক্তিতর্ক শেষে রায়ে ৭ আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন—জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নামে একজনকে খালাশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আদালতে আপিল করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষও খালাস পাওয়া আসামির মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করেছেন। বর্তমানে এই মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট জঙ্গিবাদবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। এর মধ্যে ঢাকার জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষ ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ২০টি অভিযান চালায়। এসব অভিযানে ৬৩ জন জঙ্গি নিহত হয়।
ঢাকা/ইবিটাইমস/এমএন