ভোলার চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ে; এলোমেলো করে দিচ্ছে জীবন

সাব্বির আলম বাবু, ভোলা: ভোলার উপকূলের চরাঞ্চল যেনো বাল্যবিয়ে, নারীর প্রতি অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান।

বাল্যবিয়ে নারীর জীবন এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাড়ছে পারিবারিক কলহ, নির্যাতন আর বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। কম বয়সে বিয়ের কারণে নারীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ-বালাই। অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তারা মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন।

চরফ্যাসন উপজেলার কুকরী মুকরীর সুমি বেগম, রেশমা বেগম, আয়শা বেগম, আছিয়া বেগম সহ আরও অনেকের জীবন কাহিনী বলে দেয় শুধুমাত্র বাল্যবিয়ের কারণে তাদের জীবনে নেমে এসেছে কালো অন্ধকার। কদিন আগেই বিয়ের পিড়িতে বসা কুকরীর কিশোরী জয়নব বেগমকে হয়তো অল্প সময়ের ব্যবধানে জীবনের কঠিন সংকট মোকাবেলা করতে হবে।

কুকরী মুকরীর দক্ষিণ প্রান্তে রসুলপুর গ্রামে স্বামীর সঙ্গে দুই যমজ শিশুকন্যা নিয়ে বসবাস করছেন সুমি। লেখা পড়ায় বেশ ভালো হলেও অষ্টম শ্রেণীর পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি নূরুল ইসলাম হাওলাদারের মা হারানো মেয়ে সুমির। মা পিয়ারা বেগমের মৃত্যুর পর ঘরে আসে সৎ মা নিলুফা বেগম। সুমিকে সইতে হয় নানান গঞ্জনা। লেখাপড়া বন্ধ করেই তাকে বিয়ে দেয়া হয়। এখন দুই সন্তানের মা সে। সুমি বুঝতে পারছেন, বাল্যবিয়ে তার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে।

বেড়ি বাঁধের বাইরে সুমি বেগমের ছোট্ট ঘর থেকে বের হয়ে খানিক দূরে এলে আবদুল হক হাওলাদারের ঘর। সেকঅনে আছেন আরেক কাহিনী। তার বড় ছেলে জুয়েল হাওলাদার সাত বছর আগে যাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে, সেই রেশমা বেগমের বয়স এখন ২১ বছরের বেশি হবে না। অল্প বয়সে ঘরের সব কাজ সামাল দেওয়ার পর দুটো সন্তানও এসেছে তার কোলে। এই ঘরেরই জয়নব বেগম ওরফে লাভলীর বিয়ে হয়ে গেল মাত্র কয়েকদিন আগে। পঞ্চম শ্রেণীতে সে কেবল বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছে। জয়নব এখনও বাবা আবদুল হকের ঘরেই আছে। হয়তো সে এখনও বুঝতে পারছে না, সামনের জীবনে সে কী সংকটে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু সে বিষয়ে জয়নবের মা আমেনা বেগমেরও এখন পর্যন্ত কোনো চিন্তা আসেনি। তবে পাশের বাড়িতে বউ হয়ে আসা নূরনাহার, যার বয়স এখন ৩৩ বছর, তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে। তিন ছেলেমেয়ের মা এই নারী বলেন, আগে তো আমরা এতকিছু বুঝি নাই। বিয়ের পর বুঝতে পারছি ছোট বেলায় বিয়ে হলে কী সমস্যা দেখা দেয়। নিজের অল্প বয়সে বিয়ে হলেও মেয়েকে এই ভোগান্তিতে ফেলতে চান না তিনি।

কুকরী মুকরীর বাবুগঞ্জ এলাকায় আছিয়া বেগমের বয়স ২০ পার হয়নি এখনও। বিয়ে হয়েছে ৫ বছর আগে। কোলে শিশু সন্তান নিয়ে বলছিলেন জীবনের গল্প। জানালেন, বিয়ের পর থেকে ভালো নেই। নানান রোগ বালাই বাসা বেঁধেছে শরীরে। কিন্তু এসব রোগ বাল্যবিয়ের কারণে কি না, তা বলতে পারেন না আছিয়া। খানিক দূরে শাহিনুর বেগমের ঘরে গিয়েও অবাক হতে হলো। তার মেয়েদের প্রায় সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে ছোটবেলা। দরিদ্র পরিবারে ঘরের কাজ, বাইরের কাজ করতে গিয়ে এরা এখন খুব ক্লান্ত। এই শাহিনুরের এক ছেলে আল আমীন অল্প বয়সেই বিয়ে করে এনেছেন আরেক শিশু আয়শাকে। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার জীবনটাও ন্যূয়ে পড়েছে।

অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া চর মোন্তাজের জাহাঙ্গীর হাওলাদারের মেয়ে মমতাজের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। এমন এক দূরারোগ্য ব্যধি বাসা বেঁধে, স্বামীও এখন তাকে নিতে অনীহা দেখাচ্ছে। তিন সন্তান নিয়ে মমতাজ পড়ে আছেন বাবার বাড়িতে। তার স্বামী নানান অজুহাত দেখাচ্ছে, যৌতুক দাবি করছেন। অথচ মমতাজের অসুস্থতা জনিত কারণেই আগ্রহ কমে গেছে স্বামী কবির হাওলাদারের। এমন হাজারো ঘটনার নীরব সাক্ষী উপকূলের জনপদ।

ঘরের ‘বোঝা’ কমাতে মেয়েকে ছোট বেলায় বিয়ে দেয়ার পর সে বোঝা আসলে কমে না। বরং বাড়ে চাপ; সেটা কখনো যৌতুকের, কখনো স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা মেয়ের সংসারের বোঝা।

ভোলার চরফ্যাসনের সর্বদক্ষিণে সমুদ্র মোহনায় জেগে থাকা কুকরী মুকরীর অবকাঠামোর উন্নতি হচ্ছে প্রতিদিনই। আলো ঝলমল কুকরি মুকরী দেখে ভালোই লাগে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চিত্র কষ্ট দেবে যে কাউকে। শুধু বাল্য বিয়ে নয়, আছে যৌতুক আর বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনা। শিক্ষায় অনগ্রসরতা এখনও বিদ্যমান। মানুষজনের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে খুব কম।

বাল্যবিয়ে প্রসঙ্গে আলাপ হয় কুকরী মুকরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাল্যবিয়ে আমরা রোধ করতে পারিনি। কেন পারছি না, আমি সেটাও সঠিক ভাবে বলতে পারছি না। আমি প্রায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বাল্যবিয়ে বিষয়ে ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ্যে কথা বলি, বিভিন্ন সভা-সমিতিতে কথা বলি। এখানে বাল্যবিয়ের ধারণা গুলো বদলে গেছে। আমরা কাজী সাহেবদের ওপর চাপ প্রয়োগ করলে তারা বিয়ের রেজিষ্ট্রি করেন না। তারা বলেন, আকত হয়েছে, হুজুর দ্বারা কলমা পড়ানো হয়েছে। এ কারণে গত কয়েক বছরে কুকরিতে রেজিষ্ট্রি বিহীন বিয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

দেশের বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, সাধারণত চরম দারিদ্র, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগ প্রক্রিয়ার অভাবে বাল্যবিয়ের বন্ধ করা যাচ্চৈ না। দেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের ন্যূততম বয়স বরের ক্ষেত্রে ২১ আর কনের ক্ষেত্রে ১৮। এর চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হলে তা বাল্যবিয়ে বলে বিবেচিত হয়।

ভোলা/ইবিটাইমস/আরএন

EuroBanglaTimes

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »