সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে
আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ভারতের জাতীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছেন ভারতের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তীর নায়ক ৯৮ বছর বয়স্ক দিলীপ কুমার উরফে ইউসুফ খান গুরুতর অসুস্থ হয়ে মুম্ভাইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহুল প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে রবিবার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিলেন বর্যীয়ান এই অভিনেতাকে। অক্সিজেন সাপোর্টে রয়েছেন ৯৮ বছরের দিলীপ কুমার। ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন পড়েনি। সোমবার সে তথ্য দিয়েছেন হিন্দুজা হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ফুসফুসে পানি জমেছে বলে আরও কয়েক দিন চিকিৎসা চলবে তাঁর। কিন্তু আপাতত স্থিতিশীল রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সোমবার বিকেলে অভিনেতার টুইটার থেকে একটি ছবিও পোস্ট করা হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, স্ত্রী সাবেক অভিনেত্রী সায়রা বানু তাঁর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন হাসপাতালে। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সে খবর টুইট করেছে।
তবে দিলীপ কুমারের অসুস্থতার খবর নিয়ে টুইটারে শুরু হয়েছে বিতর্ক। অভিনেতা হিন্দু, নাকি মুসলিম, তাঁর আসল নাম ব্যবহার না করার কারণ, তাঁর বাড়ি পাকিস্তানে নাকি ভারতে, তিনি কোন দেশের নাগরিক— এই সব প্রশ্ন ছোড়ার সুযোগ ছাড়ছেন না নেটাগরিকের একাংশ। তার উপরে তাঁর মৃত্যুর খবরে ভরে উঠেছে টুইটারে।
টুইটারে যে ক’টা মন্তব্য পড়েছে, তার মধ্যে ২ থেকে ৩টিতে অভিনেতার শরীর সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। নয়তো কেউ বলেছেন, ‘পাকিস্তানিদের পিছনে সময় নষ্ট করছেন কেন?’ কেউ সেই পোস্টের তলায় জীবিত দিলীপের আত্মার শান্তি কামনা করে এসেছেন। কেউ কেউ তাঁর নাম নিয়ে ব্যস্ত। কেন তাঁর আসল নাম অর্থাৎ ইউসুফ খান ব্যবহার করা হচ্ছে না, সেই নিয়ে রাগ প্রকাশ করেছেন। জনৈক নেটাগরিকের মতে, যখনই দিলীপের আসল নাম প্রকাশ্যে এসেছে, তখনই তাঁর মৃত্যুকামনা করছেন এক দল মানুষ। আর সেখান থেকেই তাঁকে ঘিরে মৃত্যুর ভুয়ো খবর রটেছে।
রবিবার রাতেই তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী সায়রা বানু টুইট করে জানিয়েছেন, ভুয়ো মৃত্যুর খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে। হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে কোনও বার্তা এলে তা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। তাঁর কথায়, ‘সাহাব এখন ভাল আছেন। আগামী ২-৩ দিনে ছাড়া পেয়ে যাবেন,’ইনশাআল্লাহ্’।
দিলীপ কুমার (ইউসুফ খান) ভারতীয় চলচ্চিত্রের একজন সাবেক অভিনেতা। তিনি ১১ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে বৃটিশ ভারতের পেশোয়ারে (এখন খাইবার পাখতুনখা, পাকিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম মুহাম্মদ ইউসুফ খান।
তিনি ১৯৪৪ সালে “বোম্বে টকিজের” ব্যানারে “জোয়ার ভাটা” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পে পদার্পণ করেন। তিনি চলচ্চিত্র শিল্প ছয় দশকের অধিক সময় ধরে বিচরণ করেছেন এবং অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি ছায়াছবিতে। তিনি বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্রময় ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, যেমন- রোমান্টিক ধাঁচের চলচ্চিত্র হিসেবে ১৯৪৯ সালের আন্দাজ, ১৯৫২ সালের বেপরোয়া বা হঠকারী এবং চালবাজ চরিত্রে আন, ১৯৫৫ সালে নাটকীয় চলচ্চিত্র দেবদাস, ১৯৫৫ সালের হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র আজাদ, ১৯৬০ সালে ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র মুঘল-ই-আজম, এবং ১৯৬১ সালের সামাজিক ঘরানার চলচ্চিত্র গঙ্গা যমুনা।
১৯৭৬ সালে, দিলীপ কুমার ছবিতে অভিনয় থেকে পাঁচ বছর বিরতি নেন এবং ছায়াছবি ক্রান্তি প্রধান চরিত্রে অভিয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হন এবং প্রধান চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় চালিয়ে যান। যেমন: “শক্তি” (১৯৮২), “কর্ম” (১৯৮৬) এবং “সওদাগর” (১৯৯১)। তার সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র ছিল “কিলা” (১৯৯৮)। দিলীপ কুমার অভিনেত্রী “বৈজয়ন্তীমালার” সাথে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, যেখানে তারা উভয়েই একসাথে নিজেদের প্রযোজিত প্রতিষ্ঠান থেকে “গঙ্গা যমুনা” সহ সাতটি ছায়াছবিতে অভিনয় করেন। তাদের দুজনের মধ্যে সবসময়ের জন্য বোঝাপড়া খুবই ভাল ছিল।
ভারত সরকার ১৯৯১ সালে তাকে দেশের সর্বোচ্চ সন্মান “পদ্মভূষণ” পদক দিয়ে সম্মানিত করেন এবং ১৯৯৪ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রতি তার অবদানসমূহের জন্য দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পদকে ভূষিত করেন এবং রাজ্যসভায় তাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য মনোনীত করা হয়।
তিনি ১৯৫৪ সালে ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার প্রথম পদক গ্রহণ করা ব্যক্তি এবং এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পাওয়ার ইতিহাস তার ঝুলিতে যিনি এখনও পর্যন্ত মোট আটটি বিভাগে পুরস্কার জিতেছেন। সমালোচকরা হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে তাকে প্রশংসিত করেন। একটি ব্লগ পোস্টে অমিতাভ বচ্চন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে দিলীপ কুমারকে বেছে নিয়ে বিবৃতি প্রদান করেন।
দিলীপ কুমার উরফে মুহাম্মদ ইউসুফ খানের পিতা লালা গোলাম সারওয়ার একজন ফলের ব্যবসায়ী ছিলেন যিনি (মহারাষ্ট্র, ভারত) পেশোয়ার ও দেওলালীর মধ্যে অনেক ফলের বাগানের মালিক ছিলেন। তার মাতার নাম আয়েশা বেগম।
দিলীপ কুমার বৃটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার কাছাকাছি মর্যাদাপূর্ণ দেওলিয়ার বার্নস স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৯৩০ সালে শেষ সময়ে, ১২ সদস্যর পরিবার নিয়ে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান। ১৯৪০ সালে দিলীপ কুমার পুনে বাড়ি ছাড়েন যেখানে তিনি একজন ক্যান্টিন মালিক এবং একজন শুষ্ক ফল সরবরাহকারী হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে, “বম্বে টকিজ” এর মালিকানাধীন অভিনেত্রী দেবিকা রানী ও তার স্বামী হিমাংশু রাই পুনের অন্ধ সামরিক ক্যান্টিনে দিলীপ কুমারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অভিনয়ের উৎসাহ প্রদান করেন।
১৯৪৪ সালের “জোয়ার ভাটা” চলচ্চিত্রটির জন্য দিলীপকে প্রধান চরিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এই চলচ্চিত্রটিতে অভিনয়ের মাধ্যমে বলিউড শিল্পে প্রবেশ করেন। তার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ ইউসুফ খান হলেও হিন্দি লেখক ভগবতি চরণ বর্মা তাকে স্ক্রীননেম দিলীপ কুমার দেন অর্থাৎ “জোয়ার ভাটা” চলচ্চিত্রে তিনি দিলীপ কুমারের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
দিলীপ কুমার এর প্রথম চলচ্চিত্র “জোয়ার ভাটা” (১৯৪৪) অলক্ষিত ছিল যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় না পৌছাতে সাহায্য না করলেও পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে “নুর জাহানের” বিপরীতে “জঙ্গু” বক্স অফিসে তার প্রথম ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রসহ ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। তার পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসা সফল চলচ্চিত্র ছিল “শহীদ” (১৯৪৮)। তিনি বলেন, তিনি একটি ত্রিভূজ প্রেমের গল্পে রাজ কাপুর ও নার্গিস পাশাপাশি অভিনয় করেন যা মেহবুব খানের ১৯৪৯ সালের আন্দাজ সঙ্গে তার যুগান্তকারী ভূমিকা পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৫০ সালের ব্যবসা সফল বিয়োগান্তক ভূমিকায় অভিনয় করেন; জোগান (১৯৫০), দীদার (১৯৫১), দাগ (১৯৫২), দেবদাস (১৯৫৫), ইহুদী (১৯৫৮) ও মধুমতি (১৯৫৮)। তিনি মেহবুব খানের “অমর” (১৯৫৪) সালের একটি চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছায়াছবিটি তাকে “ট্রাজেডি রাজা” হিসাবে পর্দায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি “দাগ” চলচ্চিত্রটির জন্য ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার জিতে নেওয়া প্রথম অভিনেতা ছিলেন এবং দেবদাস চলচ্চিত্রটির জন্য আবারও পুরস্কার প্রাপ্তির সামনে হাজির হন। তিনি নার্গিস, কামিনী কুশল, মিনা কুমারী, মধুবালা এবং বৈজয়ন্তীমালা-সহ সময়ের শীর্ষ অনেক জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের সঙ্গে জুটি গড়ে তোলেন।
ব্যাক্তিগত জীবন দিলীপ কুমার ১৯৬৬ সালে তার চেয়ে ২২ বছর কম বয়সী সৌন্দর্য রাণী অভিনেত্রী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন। তিনি তার স্ত্রী সায়রা বানুর সাথে ২০১৩ সালে মক্কা ওমরাহ পালন করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সায়রা বানু ও দিলীপ কুমার ভারত এবং পাকিস্তানের মানুষদের কাছাকাছি একসাথে আনার প্রচেষ্টায় সক্রিয় রয়েছেন। তিনি রাজ্যসভার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন।
তাকে ১৯৯৪ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৯৮ সালে তাকে পাকিস্তানের সরকার দ্বারা প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার নিশান-ই-ইমতিয়াজ প্রদান করা হয়। তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন। কারগিল যুদ্ধের সময়, শিব সেনা প্রধান বাল ঠাকরে বলেন, “ভারতীয় মাটির উপর যে দেশের ভয়ানক আগ্রাসন উদ্ধৃত” তাই দিলীপ কুমার তার নিশান-ই-ইমতিয়াজ পুরস্কার ফেরত দেওয়ার দাবি করেন।
দিলীপ কুমার এটির প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এই পুরস্কার মানবিক কার্যক্রমের জন্য আমাকে দেওয়া হয়েছে, যা আমার নিজের জন্য নিবেদিত। আমি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক ফাঁক দুর করে বহু বছর ধরে সেতুবন্ধনের জন্য কাজ করেছি, দরিদ্রের সাহায্যের জন্য কাজ করেছি। রাজনীতি এবং ধর্ম এই গণ্ডি তৈরি করেছে। আমি দুই দেশকে একত্রিত করার জন্য সংগ্রাম করেছি যাই হোক না কেন আমি করতে পারি। আমাকে বলুন, কারগিল সংঘাতের সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে?
কবির আহমেদ /ইবি টাইমস