ভোলা প্রতিনিধি : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট ঝোড়ো হাওয়া ও দমকা বাতাসে উপকূলীয় জেলা ভোলার ৫ টি উপজেলার ১১ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৭ হাজার ৭৩০টি ঘর। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ হাজার ৫৭৯ টি ঘর। এ ছাড়া পূর্ণিমার প্রভাবে নদীর পানি এখনও বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার ২৩টি চরের ৬৮ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি অবস্থায় আছে। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে তাদের জীবন পরিচালনা করতে হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি এসব মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কথা বলা হলেও এখনও ত্রাণ পায়নি হাজারো মানুষ। অর্ধাহারে-অনাহারে অনেকটা মানবতর দিন কাটছে তাদের।
অন্যদিকে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ায় তলিয়ে গেছে শত শত পুকুর ও মাছের অর্ধশতাধিক ঘের। যদিও জেলা প্রশাসক বলছেন, ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলমান আছে এবং শেষ হলে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা করা হবে।
ঝড়ের প্রভাবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ভোলার উপকূল। উপকূলের বেশির ভাগ এলাকায় এখন ঝড়ের ক্ষতচিহ্ন।
ঘরবাড়ি, মাছের ঘের, দোকান পাট আর গবাদি পশু হারিয়ে অনেকেই এখন দিশেহারা। পানিবন্দি হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন অনেকে।
সাগর উপকূলের দ্বীপচর চরফ্যাশনের ঢালচর, কুকরি-মুকরি ও মনপুরা উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। অনেকের ঘরে ঠিকমতো রান্নাও হচ্ছে না। জীবন বাঁচাতে অনেকে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিলেও তারা হারিয়েছেন সহায়-সম্বল। সাগর মোহনায় ঢালচর ইউনিয়নের মর্জিনা বেগম বলেন, ‘আমাগো খোঁজখবর কেউ রাহে না। গত তিনডা দিন ধইরা পানির লগে যুদ্ধ কইরা টিক্কা আছি। পানি উঠলে আমাগো কষ্টের শেষ নাই। রান্না করতো পারি না, খাইতো পারি না। পোলাইন-ছাওল লইয়া অনেক কষ্টের মইধ্যে আছি। বানের পানি তো আমাগো ঘর পইড়া গেছে। এহন ঘর কেমনে ঠিক করমু পোলাইন-ছাওল লইয়া কোন জায়গা থাকমু, সেই চিন্তায়ও বাঁচি না। শুধু আমি না, আমাগো মতো অনেক মাইনষের ঘর-দুয়ার পানিতে ভাসাইয়া লয়া গেছে, মাথা গোঁজানোর মতো জায়গা নাই। এহন সরকার যদি আমাগো দিকে চায়, তাইলে আমাগো কিছুডা রক্ষা হইব।’
মর্জিনার মতো একই অবস্থা ঢালচরের শতাধিক পরিবারের। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে প্রচণ্ড বাতাস ও তীব্র পানির চাপে ঘরের মাটি নরম হয়ে ঘর পড়ে গেছে। এখন খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটাচ্ছে ঢালচরের হাজারো মানুষ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা খাবার ছাড়া তেমন কিছুই জোটেনি তাদের ভাগ্যে। বিধ্বস্ত ঘরের মালিক মামুন মাঝি বলেন, ‘নদীর পাড়ে থাকি আমরা। মাছ ধরন বন্ধ থাকায় এমনেই বইসা রইছি। তার উপর তুফানে বাড়িটা ফালায়া দিল। পোলাইন-ছাওল লইয়া কই থাহুম। টাকা নাই ঘর যে আবার নতুন কইরা করুম।’ চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউপির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম হাওলাদার বলেন, ‘গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আমাদের ঢালচরের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বছর ঘুরতেই আবারও দুর্যোগের হানা। ইয়াসের প্রভাবে এই ইউনিয়নের শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ফসলি জমি, মাছের ঘের, মৎস্য আড়তসহ গবাদিপশু। পানি এখনও ওঠার কারণে মানুষ এখন খাদ্য সংকটে আছে। তাই প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, ঢালচরবাসীর জন্য যেন দ্রুত সহায়তা পাঠায়।’
চরফ্যাশনের আহম্মদপুর ইউনিয়নের আব্দুল হামিদ বলেন, ‘ইয়াসের প্রভাবে প্রচণ্ড বাতাসে নদীর পানি ঢুকে আমার মাছের ৬টি ঘেরের লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ ভেসে গেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মাছের চাষাবাদ করছিলাম। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগে শুরুতেই সব শেষ হয়ে গেল পানির কারণে।’ একই এলাকার এনায়েত পাটারী বলেন, ‘নদীতে পানি বাড়তে থাকায় সেই পানি খাল দিয়ে ঢুকে আমাদের ঘেরের মাছ সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন ধারদেনা কীভাবে শোধ করব, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
প্রবল জোয়ারের চাপে জেলার ১৫টি পয়েন্টে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে বাঁধের ৪০ মিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাবুল আক্তার জানান, বাঁধের বাইরে যেসব নিচু এলাকা রয়েছে, সবগুলো তলিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে শহর রক্ষা বাঁধের জন্য ৩৫ হাজার জিও ব্যাগ মজুত করা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো দ্রুত সংস্কার করছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন বলেন, ইয়াসের প্রভাবে ভোলার ২৩টি দুর্গম এলাকায় ৬৮ হাজারের মতো মানুষ পানি বন্দি হয়ে আছে। জোয়ারের কারণে পানি উঠছে আবার নামছে। এসব এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরির পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন করা হবে।
তিনি জানান, ভোলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলোকে পুনর্বাসন করার জন্য ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ফান্ড রয়েছে। ৪২ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল মজুত রয়েছে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে খাদ্য বিতরণ ও যাতায়াত খরচের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ঝড়ের প্রভাবে ভোলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫০টি পয়েন্টে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৮০ মিটার সম্পূর্ণ এবং ১৫ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টের মধ্য ডিভিশন-১ এর আওতায় ১৬ ও ডিভিশন-২ এর আওতায় ৩৪ পয়েন্ট রয়েছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মধ্যে ভোলা সদর, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিনে সাড়ে ৬ কিলোমিটার এবং মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন ও তজুমদ্দিনে ৯ কিলোমিটার। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মধ্যে বোরহানউদ্দিনের হাসান নগর ও মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নে ৮০ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব পয়েন্টে জোয়ার এলে ফের প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত উপকূলের মানুষ। তারা দ্রুত বাঁধ মেরামতের দাবি জানিয়েছেন।
পাউবো জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় মেঘনার পানি বিপদ সীমার ৮৩ ও ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ৪-৫ ফুট পানিতে তলিয়ে যায় উপকূলের ৩০টি দ্বীপচর। পানিবন্দি হয়ে পড়েন ৫০ হাজার মানুষ। কিছু কিছু পয়েন্ট জোয়ারের পানি নেমে গেলেও কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. বাবুল আখতার জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ৮০ মিটার বাঁধ ইতোমধ্যে মেরামত করা হয়েছে। এছাড়া বাকি সাড়ে ১৫ কিলোমিটার বাঁধের মেরামত কাজ চলছে। এসব বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও জোয়ারের পানি প্রবেশের সম্ভাবনা নেই। বাঁধের সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা ভালো।
সাব্বির আলম বাবু/ইবি টাইমস