আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আরও উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতের উরিষ্যায় আঘাত হেনেছে। এ সময় ঝড়টির বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবর থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বুধবার ভারতীয় সময় সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ভারতের উপকূলীয় রাজ্য ওড়িশ্যার বালেশ্বরের দক্ষিণে আছড়ে পড়েছে অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। তবে তার আগে থেকেই প্রভাব শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উপকূল এলাকায়। বিশেষ করে পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়েছে। জল ঢুকতে শুরু করেছে উপকূলবর্তী এলাকায়। এ ভাবে জলোচ্ছ্বাসের একটা বড় কারণ ভরা কোটাল বলেই জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরের আবহাওয়া অধিদপ্তর।
বুধবার পূর্ণিমা। সেই সঙ্গে রয়েছে চন্দ্রগ্রহণ। পূর্ণিমার প্রভাবে বুধবার সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে শুরু হবে জোয়ার। সকাল ১১টা ৩৭ মিনিটে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছবে জোয়ার। জোয়ার চলাকালীন জলের উচ্চতা সর্বাধিক সাড়ে ৫ মিটার উঠতে পারে। অন্য দিকে বুধবার দুপুর ৩টো ১৫ মিনিটে শুরু হওয়ার কথা পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। চলবে সন্ধ্যা ৬টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত। ২০২১ সালে এটিই প্রথম ও শেষ ‘ব্লাড মুন’ হতে চলেছে।
পূর্বেই পূর্বাভাস ছিল বুধবার দুপুরের মধ্যে স্থলভাগে আছড়ে পড়বে ইয়াস। কিন্তু গতি বাড়িয়ে বুধবার সকাল ৯টা ১৫ থেকেই শুরু হয়েছে স্থলভাগে আছড়ে পড়ার প্রক্রিয়া। ফলে ভরা কোটাল ও ঘূর্ণিঝড়ের স্থলভাগে আছড়ে পড়া প্রায় একই সময় হয়েছে। আর এই জোড়া ফলায় দুর্যোগ ও দুর্ভোগ বেড়েছে উপকূল এলাকার বাসিন্দাদের। একদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরে দিঘা, শঙ্করপুর, মন্দারমণি, তাজপুর এলাকা জলমগ্ন, অন্য দিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, বকখালি প্রভৃতি এলাকায় একের পর এক গ্রামে জল ঢুকেছে। ফলে সমস্যায় পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, আজ বুধবার সকাল ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে ওড়িশ্যায় আঘাত হানে সাইক্লোন ইয়াস। ঘূর্ণিঝড়টি রাজ্যে অন্তত তিন-চার ঘণ্টা তাণ্ডব চালাতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ওড়িশ্যার বালেশ্বরের দক্ষিণে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড়টি। ঝড়ের তাণ্ডবে প্রচণ্ড বেগে ঝোড়ো বাতাস বইছে। এতে করে রাজ্যের জগৎসিংপুর, কেন্দ্রপাড়া, ভদ্রক, বালাসোর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যদিও ভারতীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল আজ দুপুরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আছড়ে পড়বে। এর আগে ভোর থেকে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা সৈকত থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে চলে আসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। একই সময় ওড়িশ্যার প্যারাদ্বীপ থেকে ১২০ কিলোমিটার পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এবং বলেশ্বর থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে সরে আসে ঝড়টি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়া অফিসের উদ্ধৃতি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছে যে,এই রাজ্যের উপকূল এলাকায় ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে তাণ্ডব চালাবে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়ায় ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৭৫ থেকে ১১০ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ও আবহাওয়া অফিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে অবস্থান করছেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়হউপকূল এলাকার বাসিন্দাদের প্রতি তাঁর সতর্কবার্তা, যত ক্ষণ না প্রশাসন অনুমতি দিচ্ছে, কেহ ত্রাণ কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করবেন না। বুধবার সকালেই ইয়াস নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন মমতা। নবান্নের কন্ট্রোল রুম থেকে তিনি বলেন, ‘‘বহু এলাকা ভেসে গিয়েছে। ১৫ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি আমরা। তাঁদের ত্রাণ কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভরা কোটালের কারণে উপকূল এলাকাগুলিতে প্লাবন বেশি হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষকে আমার অনুরোধ যাঁরা ত্রাণ কেন্দ্রে রয়েছেন, তাঁরা এখন বাড়ি ফেরার চেষ্টা করবেন না। প্রশাসন অনুমতি দিলে তবেই বাইরে বার হবেন।’’
বুধবার সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যে বিভিন্ন জেলার পরিস্থিতি সম্পর্কেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘গোসাবায় প্লাবিত হয়েছে বহু গ্রাম। শঙ্করপুর, দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর ভাসছে।’’ পূর্ব মেদিনীপুরে ৫১ টি নদীবাঁধ ভেঙে গিয়েছে বলেও জানান মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াস তো এসেছেই। তার উপর বুধবার ভরা কোটালও চলছে সমুদ্রে। সে জন্যই প্লাবন বেশি হচ্ছে।’’
এদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বড় প্রভাব ফেলতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি। বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, পূর্ণিমা হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ বেশী ভুগবে। আজ সকাল ৯টায় ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২০ কিলোমিটার পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২০ কিলোমিটার পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৩০ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৫৫ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
আব্হাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে রয়েছে- খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালীসহ আশপাশের এলাকা। পূর্ণিমার কারণে জলোচ্ছ্বাস হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এছাড়া সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে তিন(৩) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস অতিক্রম করার সময়ে দেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলাগুলো এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৮০-১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
এছাড়া পূর্ণিমার প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট অধিক উচ্চতার জোয়ারে প্লাবিত হতে পারে।উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
কবির আহমেদ/ ইবি টাইমস