ঢাকা: পথে পথে মৃত্যুমিছিল বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপের দাবিতে ৪ মাসের পথদূর্ঘটনার তথ্য প্রতিবেদন পাঠ এবং অবস্থান কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়েছে। আকাশ-সড়ক-রেল ও নৌপথকে নিরাপদ এবং যাত্রী-মালিক-শ্রমিক অধিকার রক্ষায় দেশের একমাত্র স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন সেভ দ্য রোড গত ১২ যুগের পথচলার ধারাবাহিকতায় আগামী ১২ মে বেলা ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ কর্মসূচী পালন করে।
প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদীর সভাপতিত্বে এতে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন মহাসচিব শান্তা ফারজানা। বক্তব্য রাখেন সেভ দ্য রোড-এর ভাইস চেয়ারম্যান বিকাশ রায়, ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আনজুমান আরা শিল্পী, সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল মল্লিক, ইভানা শাহীন প্রমুখ।
করোনা পরিস্থিতির দ্বিতীয় ঢেউ সামলে লকডাউন ঘোষণা করলেও সব বাঁধা ভেঙ্গে চলছে সড়ক ও নৌপথে মানুষের চলাচল। ইদকে ঘিরে আরো বেড়েছে মানুষের দূরদূরান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা। সকল লকডাউন-বাঁধা ভেঙ্গে নিজের কথা না ভেবে, পরিবারের কথা না ভেবে যখন নাড়ির টানে বাড়ির পথে ছুটছে মানুষ তখন নির্মম পথ দূর্ঘটনা বেড়েই চলছে। এর পেছনে রয়েছে সরকারের একটি বিশেষ মহলের ষড়যন্ত্র, রয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের অপরাধ-দুর্নীতি-ব্যর্থতা। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সেভ দ্য রোড-এর বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের দেয়া তথ্যনুসারে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরের মত এবছরও প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে আমাদের সামনে সবার আগে উঠে এসেছে অপরাধ-দুর্নীতি ও অসচেতনতার চিত্র। ২০২১ সালের জানুয়ারী থেকে মে মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত আকাশপথে কোন দূর্ঘটনার সংবাদ বা তথ্য সেভ দ্য রোড-এর কাছে না থাকলেও জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসে ১৭ টি রেল দূর্ঘটনার সংবাদ গণমাধ্যমের তথ্যনুযায়ী আমাদের মিডিয়াসেল-এ সংরক্ষিত আছে। যার প্রতিটি দূর্ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা। সড়কপথে বছরের শুরু থেকেই ছিলো চরম নৈরাজ্য-অস্থিরতা-দুর্নীতি-চাঁদাবাজী ও একের পর এক দূর্ঘটনার চিত্র। নৌপথে বরাবরের মত নৌপুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি-দায়িত্বে অবহেলার কারণে ১ জানুয়ারী থেকে ১০ মে পর্যন্ত ছিলো চরম বিশৃংখলা-দুর্ঘটনা-মৃত্যুমিছিল।
নদীপথে তৈরি হওয়া বিভিন্ন নীতিবিবর্জিত তথাকথিত সিস্টেম-এর কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। যদি গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে বলি, স্পষ্ট এটাই যে, বাংলাদেশে সড়ক ও নৌপথে পুলিশ-প্রশাসনের দুর্নীতির কারণে নদীপথে নিষেধ থাকা স্বত্বেও বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ চলছে অহরহ। মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ী ঘাটে বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছে। আহতও হয়েছে অনেকে। অবশ্য সেই ঘটনার পর যথারীতি জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এই পর্যন্তই শেষ, আর কোন ফলোআপ পাওয়া যাবে না সংশ্লিষ্টদের কাছে। বড়জোর যেই ব্যক্তি এই স্পিডবোটের মালিক তাকে আটক করবে; অথচ তাঁর কাছ থেকেই প্রতিদিন প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা অর্থ নিয়ে এই বাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো শিপের ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছিলো। অথচ সেই কার্গোর মালিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আত্মিয় হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে চলে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই ঘটনার পরপরই সেই কাগোর রং পরিবর্তন করে দ্রুত তা সরিয়ে নেয়ার সংবাদ আমরা গণমাধ্যমে দেখলেও নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ ঘাতক কার্গো বা এর মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে। প্রতিনিয়ত এমন নৌ দূর্ঘটনা অহরহ ঘটলেও অধিকাংশই থেকে যায় গণমাধ্যমের সংবাদের বাইরে। সেভ দ্য রোড চেষ্টা করছে সারাদেশে স্বেচ্ছাসেবিদের মাধ্যমে সেই তথ্য তুলে আনতে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে সড়ক-মহাসড়কে ১০৯৮টি দুর্ঘটনায় ৫৭৭ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে পুরুষ ৪১০ জন, নারী ৮৭ জন এবং শিশু ৮০ জন। সেভ দ্য রোড-এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন সাধারণ যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক-মালিক ও পথ গবেষকগণ। দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই চালকদের অদক্ষতা ও বেপরোয়া মনোভাব, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন, মার্কিং ও জেব্রা ক্রসিং চালক এবং পথচারীদের না মানার প্রবণতা, নগরীর যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা এবং ব্যবহার উপযোগী না থাকা, বিদ্যমান ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের অনীহা, পথচারীদের বেখেয়ালি-অসতর্কভাবে রাস্তায় হাঁটা ও রাস্তা পারাপারের অভ্যাস, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, গান শোনা ও চ্যাটিং করা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, প্রশিক্ষণহীনদের মোটরসাইকেল ও স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন চালানো, শিশু-কিশোরদের এলোমেলোভাবে রাস্তায় হাঁটাচলা করা, সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ এবং সড়কের ওপর হাট-বাজার গড়ে উঠা, জনসাধারণের মধ্যে সড়কে নিরাপদ চলাচল বিষয়ে জ্ঞান না থাকা এবং অবহেলার মানসিকতার কারণে হয়ে থাকে।
সেভ দ্য রোড-এর ৭ দফা হলো- ১. মিরেরসরাই ট্রাজেডিতে নিহতদের স্মরণে ১১ জুলাইকে ‘নিরাপদ পথ দিবস’ ঘোষণা করতে হবে। ২. ফুটপাত দখলমুক্ত করে যাত্রীদের চলাচলের সুবিধা দিতে হবে। ৩. সড়ক পথে ধর্ষণ-হয়রানি রোধে ফিটনেস বিহীন বাহন নিষিদ্ধ এবং কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যতিত চালক-সহযোগি নিয়োগ ও হেলপারদ্বারা পরিবহন চালানো বন্ধে সংশ্লিষ্ট সকলকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ৪. সড়ক-নৌ-রেল ও আকাশ পথ দূর্ঘটনায় নিহতদের কমপক্ষে ১০ লাখ ও আহতদের ৩ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ সরকারীভাবে দিতে হবে এবং চালক-যাত্রীদের সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে পথনাটক, টিভি- রেডিওতে নাটিকা প্রচারের উদ্যেগ গ্রহণ করতে হবে। ৫. ‘ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স রুল’ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সত্যিকারের সম্মৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে ‘ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটালিয়ন’ বাস্তবায়ন ও পাঠ্যবইয়ে পথচলাচলের সচেতনতামূলক নির্দেশিকা সংযুক্ত করতে হবে। ৬. পথ দূর্ঘটনার তদন্ত ও সাজা ত্বরান্বিত করণের মধ্য দিয়ে সতর্কতা তৈরি করতে হবে এবং ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠনের পূর্ব পর্যন্ত হাইওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ সহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা-সহমর্মিতা-সচেতনতার পাশাপাশি সকল পথের চালক-শ্রমিক ও যাত্রীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। যদি রাস্তা পারাপারের সময় কোন পথচারি ফোনে কথা বলে, তাকে আইনের আওতায় এনে জরিমানা আদায় করতে হবে। সকল পরিবহন চালকের লাইসেন্স করতে হবে। ৭. ইউলুপ বৃদ্ধি, পথ-সেতু সহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ে দূর্নীতি প্রতিরোধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যাতে ভাঙা পথ, ভাঙা সেতু আর ভাঙা কালভার্টের কারনে নতুন কোন প্রাণ দিতে না হয় সেই লক্ষ্যে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।
হাফিজা লাকী /ইবি টাইমস