ভারতে আগামী আগস্টের মধ্যে করোনায় দশ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা “দি ল্যানসেটের”

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক মেডিকেল জার্নাল দি ল্যানসেট ভারতের করোনা পরিস্থিতির জন্য মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা

 আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ ভারতের করোনার পরিস্থিতি দিনের পর দিন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত কয়েকদিন যাবৎ দৈনিক সংক্রমণ চার লাখের উপরে এবং মৃত্যুবরণ চার হাজারের উপরে অবস্থান করছে।

রবিবার ৯ মে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রবিবার দেশে নতুন করে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছে ৪ লাখ ৩ হাজার ৭৩৮ জন এবং একই দিনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ হয়েছে ৪,০৯২ জনের।

বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাবে বা তরঙ্গে বিপর্যস্ত ভারত। ভারতে করোনায় এই পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ২ লাখ ৪২ হাজার ৩৯৮ জন।

দেশটিতে এই পর্যন্ত করোনার মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২ কোটি ২২ লাখ ৯৫ হাজার ৯১১ জন। ভারতে এখন পর্যন্ত করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১ কোটি ৮৩ লাখ ১১ হাজার ৪৯৮ জন।এদিকে দেশটির শীর্ষ কয়েকটি হাসপাতালে তীব্র অক্সিজেন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দিল্লির পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। সেখানকার কমপক্ষে ছয়টি হাসপাতাল জানিয়েছে, সেখানে অক্সিজেন সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে আগামী ১ মে থেকে ভারতের ১৮ বছর বয়সী থেকে তদূর্ধ্ব সবাই টিকা নিতে পারবেন বলে ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।

এদিকে ভারতের অন্যতম জাতীয় ইংরেজী দৈনিক “ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস” জানিয়েছেন যে,যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট (Lancet) তাদের নতুন প্রকাশনায় জানিয়েছেন ভারতে করোনা মহামারীর এই নিয়ন্ত্রণহীন দ্বিতীয় তরঙ্গে আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে দশ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটবে। ল্যানসেট তাদের প্রতিবেদনে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের গাফিলতিকে এর জন্য দায়ী করেছেন।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড মূল্যায়নের উদ্ধৃতি দিয়ে ল্যানসেট জার্নাল তাদের বিশেষ প্রতিবেদনে জানান,অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমানের সংক্রমণের বিস্তারের হার ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান অনুযায়ী আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে ভারতে কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত হয়ে বিস্ময়করভাবে দশ লাখ (এক মিলিয়ন) লোকের মৃত্যুবরণ ঘটবে।

চিকিৎসা জার্নাল দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি কঠোর সম্পাদকীয় বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার কোভিড মহামারী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার চেয়ে টুইটারে সমালোচকদের সমালোচনা অপসারণে ও তাদের তিরস্কারে বেশী মনোযোগী হতে দেখা গেছে।

সংকট চলাকালীন সমালোচনা ও মুক্ত আলোচনাকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রয়াসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর যে পদক্ষেপ রয়েছে তা “অবিস্মরণীয়”বলে বলা হয়েছে জার্নালটির প্রতিবেদনে। জার্নালটি বলেছে বিশেষজ্ঞদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যদি ভারতের আগস্টের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দশ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে, তাহলে মোদী সরকার স্ব-ক্ষতিগ্রস্থ জাতীয় বিপর্যয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।

সম্পাদকীয়টিতে আরও বলা হয়েছে,করোনার সংক্রমণের বিস্তারের ঝুঁকি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা সত্ত্বেও,সরকার হিন্দু ধর্মীয় উৎসবগুলি উদযাপনের অনুমতি দিয়েছিল। এই সমস্ত ধর্মীয় উৎসবে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ লোক একত্রিত হয়েছিল এবং সেখানে করোনার কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।

ভারতের বিভিন্ন জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে এই সমস্ত উৎসবে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের বিস্তারের সংবাদ প্রকাশিত করেছে। জার্নালটি ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়ার জন্য সরকারের অসতর্কতা ও খাম-খেয়ালীর তীব্র সমালোচনা করেছেন।

দি ল্যানসেট আরও জানায়,বর্তমানে সংক্রমণের এই রেকর্ড পরিমাণ বিস্তারের ফলে হাসপাতালগুলি রোগীতে পরিপূর্ণ এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাও ক্লান্ত হয়ে অধিক মাত্রায় করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত হয়ে পড়ছে। চিকিৎসা সামগ্রী,অক্সিজেন, হাসপাতালের বিছানা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্বল্পতার ভয়াবহ চিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। ল্যানসেট জার্নালের সম্পাদকীয়টিতে আরও বলা হয়েছে যে ভারত কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে তার প্রাথমিক সাফল্যগুলিকে বিভ্রান্ত করেছে এবং এপ্রিল অবধি,সরকারের কথিত কোভিড-১৯ টাস্কফোর্স কয়েকমাসেও পূরণ হয়নি। ভারতের করোনার টিকা কর্মসূচিরও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। ল্যানসেট আরও উল্লেখ করেছেন যে, ভারতে এই পর্যন্ত মাত্র শতকরা ২% শতাংশের কম মানুষকে করোনার ভ্যাকসিন বা টিকাদান করা হয়েছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের রবিবারের প্রকাশনায় লিখেছেন যে, ভারতে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা কেন এত বাড়ছে? এর পিছনে কী কী কারণ দায়ী? শুধুই কি ভাইরাসের চরিত্র বদল? না কি অন্য কোনও কারণও রয়েছে। সব প্রশ্নের জবাব দিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্যা স্বামী নাথন।

সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সৌম্যা বলেন, ‘‘ভারতে করোনার যে প্রজাতি সক্রিয় সেটি হল বি.১.৬১৭। এই প্রজাতিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও ‘উদ্বেগজনক প্রজাতি’ আখ্যা না দিলেও ইইউ, আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশ এই ভাইরাসকে ভয়ংকর বলে আখ্যায়িত করেছে। আমার মনে হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও উচিত এই প্রজাতিকে ‘উদ্বেগজনক প্রজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা।’’

সৌম্যা আরও বলেন, ‘‘বি.১.৬১৭ প্রজাতি ক্রমাগত চরিত্র বদল করছে। তার ফলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা আরও বাড়ছে। শুধু তাই নয়, আগামী দিনে অ্যান্টিবডি রোধক হয়ে উঠতে পারে এই ভাইরাস। অর্থাৎ টিকা বা অন্যান্য কারণে শরীরে প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি হলেও এই ভাইরাসকে আটকানো মুশকিল হতে পারে। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে।’’

তবে শুধুমাত্র ভাইরাসের ক্ষমতার জন্য নয়, মানুষের সচেতনতার অভাবও ভারতে এই ব্যাপক সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলেই মনে করেন সৌম্যা। তিনি বলেন, ‘‘ভারতে জমায়েত বেড়ে গিয়েছিল। মানুষের মাস্ক পরার ও অন্যান্য কোভিড বিধি মেনে চলার প্রবণতাও কমে গিয়েছিল। তার ফলে প্রথমে নীচের স্তরে অনেক দিন ধরে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। ধীরে ধীরে সেই সংক্রমণ উল্লম্ব ভাবে বাড়তে শুরু করেছে।’’ এ ভাবে বাড়তে থাকলে একটা সময় পরে তা হাতের বাইরে চলে যেতে পরে বলেও সতর্ক করেছেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী।

পাশাপাশি দেশের টিকাকরণের ধীর গতিকেও দায়ী করেছেন সৌম্যা। তাঁর মতে, ‘‘ভারতে এখনও পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ ভাবে চলতে থাকলে বছর গড়িয়ে যাবে সবাইকে টিকা দিতে। তত দিনে ভাইরাস হয়তো নিজের চরিত্র বদল করে ফেলবে। তখন আর বর্তমান টিকার কার্যকারিতা থাকবে না।’’ভাইরাস যত ছড়াবে তত তার চরিত্র বদলের আশঙ্কা বাড়বে বলেও সতর্ক করেছেন সৌম্যা। তিনি বলেন, ‘‘যত ভাইরাস ছড়াবে তত তার মধ্যে পরিবর্তন হবে। চরিত্র বদল করে নতুন নতুন প্রজাতি দেখা দেবে। তখন হয়তো বর্তমানে ব্যবহার করা টিকা কোনও কাজেই দেবে না। এটাই আগামী দুনিয়ার কাছে সমস্যার হতে চলেছে। তাই আগে থেকে সতর্ক হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে।’’

কবির আহমেদ/ ইবি টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »