মক্কার কাবা শরিফে অবস্থিত ‘জান্নাতি’ পাথর হাজরে আসওয়াদের প্রথম স্বচ্ছ ছবি প্রকাশ

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ সৌদি আরব থেকে সৌদি ইংরেজী দৈনিক “Saudi Gazette” জানিয়েছেন যে,ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কাবা শরিফে অবস্থিত ‘জান্নাতি’ পাথর হাজরে আসওয়াদের (Hajar Al-Aswad) স্বচ্ছ ছবি প্রকাশ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। পত্রিকাটি জানায়, পবিত্র রমযান মাসে ইতিহাসে এই প্রথম কাবা শরিফে অবস্থিত হাজরে আসওয়াদের (পবিত্র কালো পাথর) এর স্ফটিক স্বচ্ছ ছবি তুলেছেন সৌদি আরবের হারামাইন শরিফের(মক্কা ও মদিনা) রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তারা।

সৌদি তথ্য মন্ত্রণালয়ের জনৈক উপদেষ্টা এক বিবৃতিতে বলেন, ৪৯ হাজার মেগাপিক্সেলের এই ছবিগুলো তুলতে সময় লেগেছে ৭ ঘন্টা। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, পবিত্র কালো পাথরটি যেহেতু ‘জান্নাতের পাথর’, প্রথমবারের মতো উচ্চ রেজ্যুলেশনের ছবিগুলো এই বার্তা দিচ্ছে যে জান্নাত কত সুন্দর হবে।

এই পবিত্র হাজরে আসওয়াদ পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। পাথরটি পবিত্র কাবা ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার (চার ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। বর্তমানে পাথরটি আট টুকরো। হজরত আবদুল্লাহ বিন জোবায়েরের শাসনামলে কাবা শরিফে আগুন লাগলে হাজরে আসওয়াদ কয়েক টুকরা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরে ভাঙা টুকরাগুলো রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদের আটটি টুকরা দেখা যায়। বড় টুকরাটি খেজুরের সমান। ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী এই পাথর আদি মানব হযরত আদম আঃ ও হাওয়া আঃ এর সময় থেকে পৃথিবীতে রয়েছে।

হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেন, ‘হাজরে আসওয়াদ’ প্রথমে দুধ বা বরফের চেয়েও সাদা ও মসৃণ অবস্থায় জান্নাত থেকে অবতীর্ণ করা হয়। অতঃপর আদম সন্তানের পাপে তা কলো হয়ে যায়।’[তিরমিজি, মিশকাত]

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেছেন,”হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।”[সহীহ তিরমিযি, হাদিস-৮৭৭]

হাজরে আসওয়াদের ঐতিহাসিক তথ্য, ইসলামপূর্ব কোরাইশদের যুগে কাবা শরিফের গিলাফ যখন পুড়ে গিয়েছিল, তখন হাজরে আসওয়াদও পুড়ে গিয়েছিল। ফলে তার কৃষ্ণতা আরো বৃদ্ধি পায়।

রাসুলের নবুয়তপূর্ব সময়ে কাবা পুনর্নির্মাণের পর হাজরে আসওয়াদ আগের স্থানে কে বসাবেন—এটি নিয়ে কোরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধেছিল। তখন মহানবী (সা.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন। গোত্রপ্রধানরা চাদরটি ধরে কাবা চত্বর পর্যন্ত নিয়ে গেলে নবী করিম (সা.) নিজ হাতে তা কাবার দেয়ালে স্থাপন করেন এবং দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান।

আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.)-এর শাসনামলে হাজরে আসওয়াদ ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি তা রুপা দিয়ে বাঁধাই করেছেন। আর তিনিই সর্বপ্রথম হাজরে আসওয়াদকে রুপা দিয়ে বাঁধানোর সৌভাগ্য অর্জনকারী।

১৭৯ : হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ হাজরে আসওয়াদকে হীরা দিয়ে ছিদ্র করে রুপা দিয়ে ঢালাই করেন।

৩১৭ : হিজরিতে কারামতিয়ারা হারাম শরিফে অতর্কিত আক্রমণ করে হাজরে আসওয়াদ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে ৩৩২ হিজরিতে ফিরিয়ে এনে চুনা দিয়ে তার চারপাশ এঁটে দেওয়া হয়।

৪১৩ : হিজরিতে এক নাস্তিক লৌহ শলাকা দ্বারা হাজরে আসওয়াদের ওপর হামলে পড়ে। ফলে তা ছিদ্র হয়ে যায়। এরপর বনি শায়বার কিছু লোক তার ভগ্নাংশগুলো একত্রিত করে কস্তুরী দ্বারা ধৌত করে তার টুকরোগুলো ফের জোড়া লাগিয়ে দেয়।

১৩৩১ : হিজরিতে সুলতান মুহাম্মদ রাশাদ হাজরে আসওয়াদের চারপাশে রুপার একটি নতুন বেষ্টনী তৈরি করে দেন।

১৩৫১ : হিজরির এপ্রিলের ১৮ তারিখে বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আলেম-ওলামাসহ কাবা শরিফে উপস্থিত হন এবং হাজরে আসওয়াদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য তাতে মেশকে আম্বরের মতো মূল্যবান পাথর সংযুক্ত করেন।

১৪১৭:  হিজরিতে পবিত্র কাবাঘরের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদেও বিশেষ রুপার দ্বারা নতুন বেষ্টনী স্থাপিত হয়।

হাজরে আসওয়াদ এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আরও জানা যায় যে,এটি একটি প্রাগৈতিহাসিক ইসলামী নিদর্শন এবং জান্নাতের একটি মূল্যবান পাথর। হজরত আদম আ: জান্নাতে থাকাকালীন এই সুন্দর ও মনোহর পাথরটিকে খুবই পছন্দ করতেন। মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে হজরত আদম আ: পৃথিবীতে অবতরণকালে সেই পছন্দনীয় পাথরটি দুনিয়াতে নিয়ে আসেন। হজরত নূহ আ:-এর ভয়াবহ বন্যার সময় হজরত জিব্রাইল আ: পাথরটি আবু কুবাইস পাহাড়ে সংরক্ষণ করে রাখেন। হজরত ইব্রাহিম আ: কাবাঘর নির্মাণ করলে তাওয়াফ করার স্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে হজরত ইসমাইল আ: একটি পাথর তালাশ করার সময় জিব্রাইল আ: ওই পাথরটি এনে দেন। অতঃপর হজরত ইব্রাহিম আ: তা বাইতুল্লাহর এক কোণে স্থাপন করেন।

মহানবী সা:-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে কাবাঘর সংস্কার সাধনের পর হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়। মহানবী সা: দলপতিদের নিয়ে স্বহস্তে কাবাগৃহের যথাস্থানে তা স্থাপন করে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করেন।

তাবাকাতে ইবনে সায়াদের বর্ণনা মতে, জান্নাতি সেই পাথরটির রঙ বরফের শিলার চেয়েও বেশি চমকদার এবং সাদা ছিল। স্পর্শকারী ও চুম্বনকারী বনি আদমের গোনাহসমূহ শোষণ করতে করতে এর রঙ কালো হয়ে গেলে তাকে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর নামে অভিহিত করা হয়েছে।

হাদিস শরিফে হাজরে আসওয়াদ * হজরত ওমর রা: একদা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করার সময় বলেছিলেন, ‘আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারো না। আমি মহানবী সা:কে যদি তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে আমি তোমাকে কখনোই চুম্বন করতাম না।’ (বুখারি, মুসলিম)।

* যুবাইর ইবনু আরাবি রা: থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি ইবনু ওমর রা:কে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি মহানবী সা:কে তা স্পর্শ ও চুম্বন করতে দেখেছি।’ (তিরমিজি)

হাজরে আসওয়াদের মর্যাদা

* মহানবী সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন এই পাথরটিকে উপস্থিত করা হবে। তার দু’টি চোখ থাকবে তা দিয়ে সে দেখবে, জবান থাকবে যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং সাক্ষী দেবে এমন লোকের অনুকূলে যে তাকে সততার সাথে চুম্বন করেছে।’ (ইবনে মাজা)

* হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, আমি মহানবী সা:কে বলতে শুনেছি, ‘এই দুটি রোকন (হাজরে আসওয়াদ ও রোকনে ইয়ামানি) স্পর্শ করা গুনাহগুলোকে মুছে দেয়।’ (জামে তিরমিজি)

হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের নিয়মঃ

বাইতুল্লাহ শরিফ তাওয়াফের সময় এ পাথরটি স্পর্শ ও চুম্বন করে তাওয়াফ শুরু করা সুন্নাত। ভিড়ের কারণে অনেকে ভক্তির আতিশয্যে হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে ধাক্কা ধাক্কি করে লোকদের কষ্ট দিয়ে চুম্বন করা ঠিক নয়। চুম্বন দেয়া সম্ভব না হলে তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার বলে উভয় হাতের তালু তার দিকে সম্প্রসারিত করে স্বীয় হস্ত চুম্বন করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে এবং মহান আল্লাহ হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের বরকত দান করবেন। হজরত হানজালা রা: বলেন, আমি তাউস রা:কে দেখেছি, তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছ দিয়ে যেতেন, যদি ওই স্থানে ভিড় লক্ষ করতেন তবে চলে যেতেন। আর যদি ভিড়শূন্য পেতেন তখন তাকে চুম্বন করতেন তিনবার। (সুনানে নাসায়ি) মূলত এ পাথরকে চুমু দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করা।

শেষ কথাঃ

হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরটির আদি নিবাস জান্নাত হওয়ার কারণে এর স্পর্শকারী ও চুম্বনকারী দুনিয়ার জীবনেই জান্নাতের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন। মূলত এ পাথরটি কেবলই একটি পাথর যা পার্থিব জীবনে কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ কোনোটাই করতে পারে না। পাপ শোষণ হয়েছে এ ধারণা করে পুনরায় পাপে নিমজ্জিত হওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পাপমুক্ত জীবন নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে পারাই হবে এ পাথর স্পর্শ ও চুম্বনের উত্তম প্রতিদান।

কবির আহমেদ/ ইবি টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »