ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মমতার তৃণমূল কংগ্রেস

কলকাতার রাজভবনে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সাথে মমতার সাক্ষাৎ

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ আগামী ৬ মে থেকে জননির্বাচিত তৃণমূলের জয়ী প্রার্থীদের বিধায়ক হিসাবে শপথ পাঠ করাবেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে

একটানা তৃতীয়বারের মতো জয় পেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেসের এই জয়ের মধ্য দিয়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে বেসামাল ঢেউ শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে তা আপাতত প্রশমিত হল বাংলাভাষী আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এই রাজ্যে।

প্রায় মাসব্যাপী আট ধাপের বিশাল নির্বাচনযজ্ঞে শুধু ভারত নয়; সংগত কারণেই প্রতিবেশী দেশগুলোরও এ নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি ছিল। বিজেপির হয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে মাঠে নেমেছিলেন, তাতেই এ লড়াই শেষ পর্যন্ত মোদি বনাম মমতার যুদ্ধে পরিণত হয়। খেলা হবে- স্লোগান নিয়ে ভোটের মাঠে নামা মমতা তাতে জিতলেন; হেরে গেলেন মোদি। ‘নিজের মেয়েকেই বেছে নিল বাংলা’র মানুষ।

বিজেপির ভোটের রাজনীতিতে ধর্মীয় বিভাজনের যে সুর বেজে উঠেছিল, পশ্চিমবঙ্গের বহু ধর্ম-বর্ণের মানুষ তাও থামিয়ে দিল। তবে বিজেপি-তৃণমূলের এই হারজিতের লড়াইয়ে বাম-কংগ্রেস এবার দৃশ্যের আড়ালেই চলে গেল। এই জোটের শরিক আইএসএফের একটি ছাড়া কোনো আসন তারা পায়নি। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম বাম-কংগ্রেস বিধানসভার বাইরে চলে গেল।

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজ এলাকা নন্দীগ্রামে তিনি পরাজিত হয়েছেন। অবশ্য গতকাল দুপুর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত এখানে অনেক নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ‘হট ব্যাটেলফিল্ড’ নন্দীগ্রামের ফল নিয়ে চরম বিভ্রান্তি।

১৭ রাউন্ড ভোটগণনার পর তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে জয়ী হয়েছেন বলে খবর আসছিল। কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতেই মমতার জয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সবশেষ পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা সন্ধ্যায় জানিয়েছে, দিদি নয়, নন্দীগ্রামে জয় হয়েছে মমতার এক সময়ের সহযোগী ‘দাদা’ শুভেন্দুর। সাথে সাথেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবাদ করেন এবং আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার হুমকি দেন। অবশেষে নন্দীগ্রামের ফল ঘোষণা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে। এই রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আরিজ আফতাব জানান, নতুন করে গণনা হতে পারে। তবে তিনি জানান,এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন রিটার্নিং অফিসার।

ইতিপূর্বে বিকেলের দিকেএনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও আনন্দবাজার পত্রিকাসহ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো নন্দীগ্রামে মমতার জয়ের কথা জানিয়েছিল। তার কয়েক ঘণ্টা পরেই শুভেন্দু অধিকারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান,মমতা নয় এই আসনে তিনিই জয়ী হয়েছেন।

চরম বিশৃঙ্খলার পর মাঝরাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হার মেনে নিলে শুভেন্দু অধিকারীকে এখানে বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তবে নিজে হারলেও দলের জয়ের জন্য বাংলার মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, বাংলার জয়ের জন্য সকলকে অভিনন্দন। বাংলার জয়, মানুষের জয়। বাংলা আজ ভারতকে বাঁচিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গকে বিক্রির হাত থেকে বাঁচিয়েছে।

নিজের আসন নন্দীগ্রামে রাজনৈতিক শিষ্য শুভেন্দু অধিকারীর কাছে মাত্র ১৭৩৬ ভোটের ব্যবধানে হারলেও তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন মমতাই। গতকাল রবিবার দলীয় কার্যালয়ে এসে বিষয়টি তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের জানান। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হলে তাকে ছয় মাসের মধ্যে কোনো আসনে জয়ী হয়ে আসতে হবে। সে সুযোগ মমতার জন্য খোলা রয়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারী দক্ষিণ কলকাতার বীরভূমের তারাপীঠে। ব্যক্তিগত জীবনে মমতা অবিবাহিতা অর্থাৎ তিনি জীবনে বিয়ে করেননি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স,ইসলামিক ইতিহাসে M.A.এবং L.L.B. সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ এর দশক থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন।পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন।

অবশ্য ১৯৯৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস স্থাপন করেন। অনতিকাল পরেই তার দল দীর্ঘকাল বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধীশক্তিতে পরিণত হয়। ১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর সমাজবাদী পার্টি সাংসদ দারোগা প্রসাদ সরোজ “মহিলা সংরক্ষণ বিলের” বিরোধিতায় লোকসভার ওয়ালে নেমে গেলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার জামার কলার ধরে টানতে টানতে তাকে ওয়েলের বাইরে বের করে দেন। এই ঘটনায় কিছু বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়। ১৯৯৯ সালে মমতা বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে সামিল হন। এই জোট সরকার গঠন করলে তিনি রেলমন্ত্রী মনোনীত হন। অবশ্য কয়েক বৎসর পর তিনি স্বেচ্ছায় রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে নিজের দল তৃনমূল কংগ্রেসকে সুসংগঠিত করতে থাকেন।

পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে তার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিজেকেপ্রতিষ্ঠিত করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন বাগ্মী রাজনীতিবিদ। তাকে প্রায়শই দিদি বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এছাড়াও তাকে অগ্নিকন্যাও বলা হয়।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯৪ আসনের মধ্যে দুটির ভোট গ্রহণ প্রার্থীর মৃত্যুতে স্থগিত ছিল। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৪৮টি আসন। করোনা মহামারীর ভয়াবহতার মধ্যে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি  মেনে গতকাল ২৯২ আসনের ভোট গণনার পর বেসরকারি ফল ঘোষণা করে ভারতের নির্বাচন কমিশন। সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল এনডিটিভি রাতে জানায়, তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে ২১৬ টি আসনে জয় পেয়েছে। তবে কয়েকটি আসনে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকা প্রার্থীদের জয়ী ধরে নিয়ে এই ফল জানিয়েছে তারা। এদিকে, দুই শতাধিক আসনে জয়ের টার্গেটে নামা বিজেপি থেমেছে ৭৫ আসনে। কংগ্রেস শূন্য, সিপিআইএমসহ বাম জোট শূন্য এবং এই জোটের শরিক আইএসএফ পেয়েছে মাত্র ১টি আসন। অন্যান্য দলের একজন জয় পেয়েছে। ফল ঘোষণা বাকি ছিল দুটি আসনে। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের এই হারকে ঐতিহাসিক পরাজয় হিসেবে দেখছেন বিশ্নেষকরা। ২০১৬ সালে কংগ্রেস জোট ৪৪টি এবং বাম জোট ২৬টি আসন পেয়ে কিছুটা মুখ রক্ষা করতে পারলেও এবার ঝুড়ি একেবারেই শূন্য।

তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর মমতাকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসকে হটিয়ে এবার দ্বিতীয় বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে তার দল বিজেপি। টুইটে মোদি বলেন, ” মমতা দিদিকে পশ্চিমবঙ্গে তার দল তৃণমূলের জয়ের জন্য অভিনন্দন জানাই। কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জনগণের প্রত্যাশা ও করোনা মহামারী থেকে বের হয়ে আসতে সব ধরনের সম্ভাব্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।” যদিও নির্বাচনের আগে থেকেই করোনা নিয়ে মোদির বিরুদ্ধে অবহেলা ও পশ্চিমবঙ্গকে অসহযোগিতা করার অভিযোগ করে আসছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাজ্যের নেতাদের হাত থেকে নির্বাচনের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমও করেছিলেন তিনি। ঘুরেছেন বাংলার গ্রামে গ্রামেও। তার বক্তব্য ছিল খুবই আক্রমণাত্মক। অবৈধ অনুপ্রবেশ ইস্যুটি তিনিই বারবার উচ্চারণ করেছেন। তিনিই বলেছিলেন, বিজেপি জিতলে বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পার হয়ে একটি পাখিও ঢুকতে পারবে না। তবে দলের শেষ রক্ষা করতে পারেননি তিনি। ২০১৬ সালে যেখানে তিনটি আসন পেয়েছিল বিজেপি, সেখানে এবার ৭৬টি আসন পেয়েছে। এটি তাদের বড় পাওয়া। পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর এক টুইটে অমিত শাহ লিখেছেন, ‘বাংলার মানুষের রায়কে সম্মান জানাচ্ছি।’ রাজ্যে বিজেপিকে শক্তিশালী করার জন্য রাজ্যবাসীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

রাজ্যে দুর্দান্ত জয়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টুইট করে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি লিখেছেন, দুর্দান্ত জয়ের জন্য মমতাজিকে অভিনন্দন।

বিজেপি, কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের শীর্ষ নেতারাও মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক ভারতের পক্ষে লড়াই করা লেখক, বুদ্ধিজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টরাও মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিজেপির সাবেক সভাপতি রাজনাথ সিং এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ যাদব মমতার এই জয়কে মোদি-হাওয়ার বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন।

লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট বিনায়ক সেন ধারাবাহিক টুইটে মমতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। একই সঙ্গে মোদি-অমিতদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মমতার জয়কে বিরাট অগ্রযাত্রা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের দিনও ফুরিয়ে আসছে। ভারতের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও অ্যাক্টিভিস্ট কবীর সুমনও মমতার জয়কে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবতার জয় বলে বর্ণনা করেছেন।

অখিলেশ যাদব টুইটে লিখেছেন, বাংলার সচেতন নাগরিকরা বিজেপির ঘৃণার রাজনীতিকে হারিয়ে দিয়েছে। মানুষের সেবায় ব্রতী পরিশ্রমী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল নেতাদের শুভেচ্ছা। একজন নারীকে বিজেপি যেভাবে ‘দিদি, ও দিদি’ বলে কটাক্ষ করছিল; তার যোগ্য জবাব দিয়েছে বাংলার জনগণ। হ্যাশট্যাগে তিনি লেখেন, ‘দিদি, জিও দিদি।’ নির্বাচনী প্রচারে ‘দিদি… ও দিদি’ বলে মমতাকে সম্বোধন করে বহুবার ডেকেছেন মোদি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একে কটাক্ষ হিসেবে দেখেছেন।

দলের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল সন্ধ্যায় কালীঘাটে নিজ বাড়ি থেকে হেঁটে দলীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন মমতা। রাজ্যবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এবার আমাদের প্রথম কাজ হবে করোনা মোকাবিলা করা।’ মমতা বলেন, ‘এ জয় বাংলার জয়, বাংলার মানুষের জয়। এই জয় ভারতবর্ষের মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’ মমতা আরও বলেন, ‘এবার সত্যিই খেলা হয়েছে। আর সেই খেলায় আমরা জিতেছি। তাই আমি গ্রামের বিভিন্ন ক্লাবকে ৫০ হাজার ফুটবল উপহার দেব। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন চাইব। না দিলে গান্ধীজীর মূর্তির সামনে থেকে আন্দোলনে নামব।’ তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে এখন বিজয় উৎসব নয়। করোনা গেলে আমরা কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে বিজয় উৎসব করব।’

উল্লেখ্য যে,২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এককভাবে ২১১টি আসনে জিতেছিল। ২০১১ সালে ১৮৪ আসনে জিতেছিল। তবে টানা দু’বার ক্ষমতায় থাকায় অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি মনোভাব বাড়তে দেখা যায়। তৃণমূলের বিরুদ্ধে গুন্ডামি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। একই সঙ্গে মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে উত্তাপ ছড়ান মোদি-অমিতরা। রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ, নন্দীগ্রামের শুভেন্দু অধিকারী মিলে তৃণমূলকে কোণঠাসা করার মরিয়া চেষ্টা চালায়। মাঠে নামানো হয়েছিল জনপ্রিয় অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীকেও কিন্ত কিছুতেই বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে পেরে উঠতে পারে নি।

‘খেলা হবে’ স্লোগানে মাঠে নামেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একাই মাঠ কাঁপিয়েছেন। নন্দীগ্রামে প্রচারে গিয়ে চোট পাওয়া পা নিয়ে হুইলচেয়ারে করেই জেলায় জেলায় চষে বেড়ান তিনি। তুলে ধরেন কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, যুবশ্রী, কৃষক বন্ধু, স্বাস্থ্য সাথীর মতো জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের কথা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ভোটে জিতে নতুন সরকারের অধীনে প্রত্যেক গৃহিণীকে মাসে ৫০০ টাকা দেবেন। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অর্থ সহায়তা দেবেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে এবিপি আনন্দকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মমতা বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার সামাজিক নিরাপত্তার জন্য যতগুলো প্রকল্প নিয়েছে, বিশ্বে আর কোনো দেশে তা নেই।

মমতার এবার নির্বাচনের স্লোগান ছিল ‘খেলা হবে’। এ স্লোগানেই প্রচারের জন্য গান বাঁধা হয়, পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায় নির্বাচনী এলাকা। সেই স্লোগান দিয়েই বাজিমাত করেছে তৃণমূল। হুইলচেয়ারে বসে জনসভা থেকে তিনি বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন। বলেছেন, এক পায়েই এমন শট মারব না, বাংলা পার হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত খেলায় জিতেছেন তিনি। আরেকটি স্লোগান দিয়েও উত্তাপ ছড়ায় তৃণমূল- বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়। সেটিও ভোটে প্রমাণিত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বামদের সঙ্গে জোট করে অধীর রঞ্জন চৌধুরী নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস। পরে এতে যোগ দেয় ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন আইএসএফ। আট দফার এ নির্বাচনে জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির সময় ছাড়া কার্যত মাঠে দেখা যায়নি কংগ্রেসকে। ‘হারার আগে হার’ মেনে নিয়ে প্রচারে ম্রিয়মাণ ছিল দলটি। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূলকে হারাতে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সবাই পশ্চিমবঙ্গ সফর করলেও প্রচারে দেখা যায়নি রাহুল গান্ধী। এ ছাড়া মাঠের রাজনীতিতেও সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়ানোর তোড়জোড় ছিল না দলটির। ফলে এ রাজ্যে লজ্জাজনক হারের মুখে পড়ে একসময়ের ক্ষমতাসীন দলটি।

পার্লামেন্ট সদস্য হয়েও এবার বিধানসভার ভোটে লড়াই করে পরাজিত বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেছেন, বিজেপিকে জয়ী করে সুযোগ না দিয়ে পশ্চিম বাংলার মানুষ ঐতিহাসিক ভুল করেছেন। জয়ের নায়ক তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘নিষ্ঠুর নারী’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, তাকেই ভোট দিয়েছেন এ রাজ্যের মানুষ। বিজেপির পরাজয়ের পর গতকাল ফেসবুক পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে নির্বাচনে উতরে যাওয়া। দলটির শীর্ষ নেতারা এবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা করেছেন। তাদের বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বিখ্যাত মানবাধিকারকর্মী ও বুকারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের মতো অনেকে। তবে তাদের সেই বিভাজনের রাজনীতি ব্যালটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেছে পশ্চিমবঙ্গবাসী।

কবির আহমেদ/ ইবি টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »