“জনগণের প্রয়োজন মেটাতে যা যা দরকার ভারত সরকার তাই করবো”-পররাষ্ট্র সচিব
অন লাইন ডেস্কঃ বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতে কোন অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না করোনার সংক্রমণের বিস্তার। করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত ভারতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। প্রতিদিনই দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুতে রেকর্ড গড়ছে দেশটি। বৃহস্পতিবার দেশটিতে একদিনেই করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছেন ৩,৮৬,৮২৯ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৩,৫০১ জন।
করোনার পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডও মিটারের তথ্যানুযায়ী বৃহস্পতিবার ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে এই পর্যন্ত মোট আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন ১ কোটি ৮৭ লক্ষ ৫৪ হাজার ৯২৫ জন এবং এই পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন মোট ২ লক্ষ ৮ হাজার ৩১৩ জন । আক্রান্তের দিক থেকে ভারত বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় ও মৃত্যুতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। মাত্র এক সপ্তাহে ২০ লাখ নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সারিবদ্ধ লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সই বলে দিচ্ছে ভারতের করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা। কবরস্থান ও শ্মশানে সাদা গাড়ির বহর। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার আছেই। সেই সঙ্গে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা।
কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সাথে আলাপকালে রাজধানী দিল্লির সাধারণ লোকজন বলেন, আমরা কেনো ভয় পাবো না বলতে পারেন। কি হচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। অক্সিজেন নেই, হাসপাতালে বেড নেই, অ্যাম্বুলেন্সেই রোগী মারা যাচ্ছে। শ্মশানে চিতা জ্বালানোর মতো কাঠও নেই,কবরস্থানে জায়গা নেই।
গত কয়েকদিন যাবৎ দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা তিন হাজারের উপরে। এর মধ্যে শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র রাজ্যেই প্রতিদিন মারা যাচ্ছে রেকর্ড এক হাজার মানুষ। আর তাই রাজ্যটিতে নতুন করে লকডাউনের মেয়াদ আরও ১৫ দিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। ভারতে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হওয়ার হার ৯৯ শতাংশ এবং মারা যাওয়ার হার ১ শতাংশ। ভারতে বর্তমান করোনার মোট সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ৩১ লক্ষ ৭৭ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে ক্রিটিক্যাল অবস্থার মধ্যে আছেন ৮ হাজার ৯৪৪ জন মানুষ।
করোনাবিষয়ক তথ্য ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, ভারতে গত এক সপ্তাহ যাবৎ করোনায় প্রতিদিনের নতুন সংক্রমণ ৩ লাখের উপরে। আর একটানা ৯ দিন মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজারের উপরে থাকার পর গত তিনদিন যাবৎ তা বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে তিন হাজারের উপরে উঠে গেছে। গত সপ্তাহে ভারতের সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, ভারতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যুবরণ ৫,০০০ হাজারের উপর উঠে যেতে পারে।
ভারতে করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি মহারাষ্ট্রে। তারপর রয়েছে কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ। ছত্তিশগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট ও হরিয়ানার পরিস্থিতিও অবনতিশীল। করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির মুখে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাত্রিকালীন কারফিউসহ বিভিন্ন কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি টিকাদান কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ভারতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করায় দেশটি তার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অক্সিজেন, ওষুধ, হাসপাতালে শয্যার সংকটসহ নানা সমস্যায় দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম।দেশটির হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। রোগীর চাপ সামাল দিতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। রাজধানী নয়াদিল্লিসহ বিভিন্ন স্থানের অনেক হাসপাতালে অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। হাসপাতালগুলো অক্সিজেন চেয়ে জরুরি বার্তা পাঠাচ্ছে।
ভারতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্রুত অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে দেশটি। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন আমাদের বিপদের সময় ভারত আমাদের ওষুধ দিয়ে সাহায্য করেছে এখন আমরাও তাদের সাহায্য করব। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানিও বলেছে, তারা ভারতকে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।
সৌদি আরও তাৎক্ষণিকভাবে তরল অক্সিজেন পাঠিয়ে ভারতের এই ভয়াবহ বিপদে এগিয়ে এসেছে।
অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভল্ফগ্যাং মুকস্টাইন গতকাল সংবাদ সংস্থা এপিএ কে জানিয়েছে যে,অস্ট্রিয়া ভারতকে ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করবে।
এদিকে আজ ভারতের ইংরেজী দৈনিক ইন্ডিয়ান একপ্রেস জানিয়েছে এই প্রথম ভারত সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিদেশী সাহায্যের ব্যপারে মূখ খুললেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা আজ নতুন দিল্লিতে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানান, জনগণের প্রয়োজন মেটাতে যা যা দরকার ভারত সরকার তাই করবে। পত্রিকাটি জানায়, এই প্রথম কোনও উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা বিদেশী সরকারগুলির কাছ থেকে সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের কৌশলগত পছন্দকে রক্ষা করতে এবং স্বাস্থ্য সঙ্কটের মুখে চীন থেকে জরুরি চিকিৎসা সরবরাহ সংগ্রহ করার পক্ষে মন্তব্য করলেন।
পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, ভারত তার নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরে বিদেশি দেশগুলির কাছ থেকে উপহার, অনুদান এবং সহায়তা গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। কারন দেশ এখন এই শতাব্দীর অন্যতম এক ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি। দেশে বৈশ্বিক মহামারী করোনার মিউটেশন ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তার লাভের ফলে অক্সিজেন, ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জামের বিশাল সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাই ভারত সরকার এই “অত্যন্ত নজিরবিহীন এবং অত্যন্ত ব্যতিক্রমী” সময়ে দেশের মানুষের প্রয়োজন মেটাতে “যা কিছু করার দরকার তাই করবে”।
এখানে উল্লেখ্য যে,পররাষ্ট্রসচিব হিসাবে নিয়োগের পূর্বে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
কবির আহমেদ/ ইবি টাইমস