চরফ্যাসন (ভোলা) : ভোলা চরফ্যাসনের আসলামপুরে জোড়া খুনের জড়িত ছিল ভাড়াটিয়া খুনি। আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে এই খুনি ভাড়া করা হয়। খুনের আগে লম্বা সময় নিয়ে খুনের ছক সাজালেও এই পরিল্পনার সূত্রপাত হয়েছিল চট্রগ্রাম থেকে।
জোড়া খুনের মামলার প্রধান আসামী বেল্লালের স্ত্রী আসমার কথোপকথনে মিলছে এমন তথ্য। স্বজনদের চোখ এড়িয়ে পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির সমূদয় টাকা বাগিয়ে নিতে গিয়ে খুনিদের সাজানো ছকে জীবন দিয়েছে সহোদর তপন সরকার ও দুলাল সরকার। অপরদিকে তপন-দুলালের স্বজন ঠকানো এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে টাকাগুলো মেরে দেয়ার ফন্দি থেকে সাজানো হয় খুনের ছক। কিন্ত গ্রামের বর্গজমির খামারী বেলাল এবং ছোটভাই রিক্সাচালক কাশেম রাতারাতি ভয়ংকর খুনির তকমা পেলেও এই খুনের পেছনে মূল কাজটি করেছে ভাড়াটিয়া পেশাদার খুনি।
পুলিশ কম সময়ের মধ্যে মাথাবিহীন পোড়া দেহের পরিচয়, টয়লেট ট্যাংকি থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা, খুনে ব্যবহৃত ছেনী এবং খুনের মোটিভ উদ্ধারে আশাপ্রদ সাফল্য দেখালেও ভাড়াটে খুনিদের এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি।
চরফ্যাসন পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ ফ্যাশন এলাকার মৃত উপেন্দ্র সরকারের ছেলে তপন সরকার (৫৫) ও দুলাল সরকার (৪০)। বড় ভাই তপন সরকার অবিবাহিত এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি। তাদের ছোটভাই নৃপেন সরকার মা লিলা সরকারকে (৮০) নিয়ে দক্ষিণ ফ্যাশনের পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন। নৃপেন চরফ্যাসন সদর রোডের একটি স্যালুনের দোকানের মালিক ও কারিগর হিসেবে কাজ করেন।
বাবার মৃত্যুর পর দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বড়ভাই প্রতিবন্ধি তপন সরকার এবং মা লিলা সরকারের ভরপোষন চালিয়ে আসছিলেন এই নৃপেন সরকার। এই দীর্ঘ সময় ধরে মেঝভাই দুলাল সরকার ভারতে ছিলেন। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার হৃদয়পুর থানা এলাকার মৌসুমীকে বিয়ে করেন। সেসূত্রে হৃদয়পুর থানা এলাকার রেল লাইনের জমিতে স্ত্রী মৌসুমী এবং একমাত্র ছেলে তন্ময়কে (২৪) নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। দীর্ঘদিন ভারত থাকার পর ২ বছর আগে চরফ্যাসনে বাড়িতে আসেন দুলাল সরকার। এখানে এসে বড়ভাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি তপন সরকার এবং তার নিজের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ৬৬ শতাংশ জমি বিক্রির উদ্যোগ নেন। এভাবে মেঝ ভাইয়ের খপ্পড়ে পড়ে মা ও ছোটভাইকে রেখে ঘর ছাড়েন তপন। সে থেকে তপন আর বাড়ি ফিরেনি।
মা লিলা সরকার বলেছেন, দুলালের সাথে ২ বছর আগে বাড়ি ছাড়ার পর আমরা জানতাম তপন ও দুলাল ভারতে আছে। কিন্ত কিছুদিন আগে আমরা জেনেছি, গত বছর দুইভাই গোপনে এসে জমি বিক্রি করেছে। গত ডিসেম্বর মাসে আসলামপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের জাফর ফরাজির ছেলে বেল্লালকে ৬৬ শতাংশ জমি রেজিষ্ট্রি দলিল দেন তপন ও দুলাল।
গত ৮ এপ্রিল জমির গ্রহীতা বেল্লাল-এর বাড়ির দক্ষিণ পাশের জামাল ভুইয়ার পরিত্যক্ত বাড়ির বাগান থেকে মাথাবিহীন পোড়া দু’টি লাশ উদ্ধার করে চরফ্যাসন থানা পুলিশ। লাশ উদ্ধারের ১৪দিন পর বেল্লাল-এর বাড়ি সংলগ্ন মহিবুল্যাহ ফরাজির টয়লেট ট্যাংকি থেকে মাথা দু’টি উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানায়, বেল্লাল জমি দলিল নিলেও সমূদয় টাকা পরিশোধ করেনি। টাকার পাওয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় বেল্লালের আশ্রয়ে লুকিয়ে ছিল তপন ও দুলাল। এই টাকা পরিশোধ না করার হীন মানসিকতাই পরে খুনের মতো ভয়ংকর পথে নিয়ে যায় বেল্লালকে।
বেল্লালের স্ত্রী আসমা জানান, ৭ এপ্রিল গভীর রাতে স্বামী বেল্লাল বিকারগ্রস্ত অবস্থায় ঘরে ফিরেন। ছোট দুইটি সন্তানকে কোলে নিয়ে ব্যাপক কান্নাকাটি শুরু করেন। স্বামীর এমন অস্থিরতার কারণ জানতে চাই। স্বামী বেল্লাল তখন আমাকে জানায়, সে তপন ও দুলালকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। হত্যার পর মাথা কেটে সুন্দরীর খালে ফেলে দেয়া হয়েছে। দেহগুলো পুড়ে দিয়েছে। এখন লাশের কোন চিহ্ন নাই। মাথাগুলো খালের পানিতে ভেসে উঠেছে। এজন্য পানি থেকে তুলে মহিবুল্যাহর ঘরের পেছনে টয়লেট ট্যাংকিতে ফেলেছে। সে বাচবো না। তাকে ক্ষমা করে দিতে বলেছে।’
আসমা আরো জানায়, জমি দলিল হওয়ার পর তপন ও দুলালকে ১৫ লাখ টাকার মধ্যে ৩ লাখ টাকা দেয়া হয়। বাকী ১২ লাখ টাকার জন্য তপন ও দুলাল অপেক্ষা করছিল। ভাই ও ফুফু টাকার অংশ দাবী করতে পারে এমন ভয় থেকে তারা আত্মগোপনে ছিল। বেল্লালের ঘর, লালমোহন ও চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছে বেল্লাল। সর্বশেষ চরফ্যাসন থেকে টাকাসহ বেল্লাল জমি বিক্রেতা ওই দুই ভাইকে চট্রগ্রাম নিয়ে যায়। সেখানে টাকা দিয়ে তাদের ভারতে যাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্ত চট্রগ্রাম গেলে এই সিদ্ধান্ত বদলে যায়। সেখানে বেল্লালের স্ত্রী আসমার ভগ্নিপতি ছালাউদ্দিন সিএনজি চালক। ছালাউদ্দিনের বাসায় গেলে খুনের ছক কষে ছালাউদ্দিন। এতোগুলো টাকা না দিয়ে মাত্র আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে খুনির সাথে চুক্তি করে দেয় সালাউদ্দিন। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভাড়াটে খুনি খুনের মূল কাজ করে দেয়। কিন্ত এই খুনি কে বা খুনির সংখ্যাই বা কতো তা আসমাকে বলা হয়নি। সে খুনিদের দেখেও নি।
গতকাল শনিবার সকালে আসলামপুরে বেল্লালের বাড়ি গেলে স্ত্রী আসমা এসব তথ্য জানান। তবে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার পর কিছু যাত্রী নিয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাস এলাকায় ঢুকে। রাতেই মাইক্রোবাসটি উধাও হয়ে যায়। এলাকাবাসীর ধারনা, চট্রগ্রাম থেকে ভিক্টিম তপন ও দুলাল, খুনি বেল্লাল এবং ভাড়াটে খুনিরা এই মাক্রোবাসে একই সাথে আসে। এখানে এসে খুনের কাজ সম্পন্ন করে ভাড়াটে খুনিরা রাতের কোন এক সময় ওই মাক্রোবাসে চট্রগ্রাম ফিরে যায়। খুনিদের বিদায় করে নিজ বাড়িতে ফিরে যান বেল্লাল।
ক্লুবিহীন এই হত্যাকান্ডের পর পুলিশ বেল্লাল, বেল্লালের ভাই কাশেম, শ্বশুড় আবু মাঝিকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করেছেন। আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে আসামীরা জবানবন্দি দিয়েছেন বলে মামলা বাদি উপ-পরিদর্শক নুরুজ্জামান জানিয়েছেন।
এদিকে গত শুক্রবার রাতে ভোলা জেলা পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার নিশ্চিত করেছেন, আসামীদের কথিত মতে টয়লেট ট্যাংকি থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা এবং খাল থেকে খুনের ব্যবহৃত ছেণী উদ্ধার করা হয়েছে।
জামাল মোল্লা/ইবি টাইমস