উন্নয়ন বঞ্চিত সাগরকন্যা মনপুরাবাসী

ভোলা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন জেলা ভোলা। এই জেলা চারদিকে নদী বেষ্টিত। আনুমানিক ১২৩৫ সালের দিকে মেঘনা নদীর বুক ও বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা সু-বিশাল এই দ্বীপ। এটা বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বীপ। ভোলায় প্রায় অর্ধশতাধিক ছোট বড় বিছিন্ন দ্বীপ রয়েছে। এসব দ্বীপের মধ্যে মনপুরা উল্লেখ্যযোগ্য।

জেলা সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় যার অবস্থান। এর চারদিকে সাগরের অথৈ জলরাশি। প্রমত্তা মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ের তালে সিক্ত এখানকার পলিমাটি। সবুজ শ্যামল ঘেরা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা ভূমি রূপালী দ্বীপ মনপুরা। ১৩০০ শতাব্দীতে মনপুরা দ্বীপের উৎপত্তি। তবে বসবাস শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দী থেকে। তখন থেকে দ্বীপটি বাকলা চন্দ্রদ্বীপের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলে পর্তুগিজরা মনপুরায় আস্তানা গাড়েন। এখান থেকেই তারা সমগ্র বাংলায় ব্যবসা পরিচালনা করতেন।

এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হাজার হাজার একর জমিতে ম্যানগ্রোভ বনায়ন ও পর্তুগিজদের নিয়ে আসা কেশওয়ালা লোমশ কুকুর। তবে কালক্রমে হারিয়ে গেছে কেশওয়ালা লোমশ কুকুর। এখন দু’চার গ্রাম ঘুরেও কেশওয়ালা লোমশ কুকুর দেখা মেলে না। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস মনপুরাকে সাজিয়েছে সবুজের সমারোহে। এই বিশাল বৃক্ষরাজির মধ্যে আছে হরিণের অভয়াশ্রম। শীত মৌসুমে এখানকার চিত্র ভিন্ন ধরনের। অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে। অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। এখানে পাখির উড়ে বেড়ানো, সুবিশাল নদীর বুক চিরে ছুটে চলা জেলে নৌকা, হরিণের পালের ছোটাছুটি, ঘুরে বেড়ানো গরু, মহিষ, ছাগল-ভেড়ার পাল আর কেওড়া গাছের বাগান যে কারো কঠিন হৃদয়ের মনও ছুঁয়ে নেয়।

তবে দেশের অন্য সব পর্যটন কেন্দ্রের তুলনায় মনপুরার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। মাইলের পর মাইল বৃক্ষের সবুজের সমাহার যেন ক্যানভাসে আঁকা শিল্পীর নিপুণ হাতে ছোঁয়া। যেখান থেকে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের দৃশ্য উপভোগ করাসহ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখতে পর্যটকেরা ভিড় জমায়। মনপুরা উপজেলার চারপাশে রয়েছে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কয়েকটি চর। চরগুলো কিশোরীর গলার মুক্তোর মালার মতো মনপুরার সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলছে। এর মধ্যে চর কলাতলী, চর জহিরউদ্দিন (মাঝের চর), চর তাজাম্মুল, চর জামশেদ, চরপাতিলা, চর পিয়াল, চরনিজাম, লালচর, বালুয়ারচর, চর গোয়ালিয়া, সাকুচিয়া রয়েছে। এছাড়াও মেঘনা নদীর বুকে আরো নতুন কয়েকটি জেগে উঠছে। চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়েই এসব চরের জন্ম। এই ছোট-বড় ১০/১২টি চরে বন বিভাগের প্রচেষ্টায় ঘটেছে সবুজ বিপ্লব।

তবে এসব চরাঞ্চলের মানুষের জীবন বৈচিত্র্য কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। সুখ সঙ্গে দুঃখ নিয়েই তাদের জীবন। কখনো কখনো সুখ গুলো বিষাদ হয়ে ধরা দেয়। এসব চরাঞ্চলে প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। নদী ভাঙন, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, আশ্বিন-কার্তিক মাসের ‘মঙ্গা’ আর পৌষ-মাঘের কনকনে শীতের কষ্টকে সঙ্গী করে জীবন কাটাতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। নেই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বাস্থ্যসেবা। মাইলের পর মাইল অতিক্রম করেলে দেখা মিলে দু’একটি আশ্রয় কেন্দ্র। এখন তিন বেলা পেটপুরে খেতে পারে এমন পরিবারের সংখ্যা খুবই কম। কেউ হয়তো একবেলা খায়, কেউ দুইবেলা। সব মিলিয়ে চরবাসীর দুঃখ-কষ্ট যেন নিত্যসঙ্গী।

মনপুরা শহর কেন্দ্রিক কিছুটা উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও বঞ্চিত আশে পাশের চর গুলোর মানুষ। শিক্ষার অব্যবস্থা এ চরাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে জীবন ধারণের সার্বিক অগ্রগতি থেকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। নিরক্ষরতার কারণে কুসংস্কার, অসচেতনতা চরাঞ্চলের মানুষদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, আশ্রয় কেন্দ্রের অভাব সহ নানা সমস্যার শেষ নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহালদশা। বর্ষার মৌসুমে এক বাসা থেকে অন্য বাসায় ছোট ছোট নৌকা কিংবা কলা গাছের ভেলাই যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। ইউনিয়ন পরিষদ, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, থানা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সময় ভিত্তিক ছোট ছোট নৌকার উপর ভরসা রাখতে হয়। বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ার আসলে জনজীবন থমকে দাঁড়ায়। উপজেলা শহর ছাড়া নেই কোনো ডাক্তার। কখনো কখনো কবিরাজি ও ঝাড়ফুঁকে নির্ভরতায় জীবন কাটায়।

বিচ্ছিন্ন এই চরাঞ্চলে সন্ধ্যা নামতেই রাত গভীর হয়। বিদ্যুৎ আবার কি সেটাও জানে না তারা। কুপির আলোতে রাতের রান্না কিংবা খাওয়া দাওয়া কাজ শেষ করতে হয়। থানা শহরের বিকেল ৫টায় বিদ্যুৎ এলেও রাত ১১টায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পুরো মনপুরা রাত ১১টায় থমকে দাঁড়ায় ঘোর অন্ধকারে। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু পরিবার সৌর বিদ্যুৎ (সোলার) ব্যবহার করলেও ৯০ ভাগ মানুষ ঘুমিয়ে পড়েন সন্ধ্যার সঙ্গে-সঙ্গে। নীরব হয়ে যায় মনপুরা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দিনে-দিনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি চরাঞ্চলের জেলে পল্লীগুলোতে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের ভাঙাচোরা চালা বেয়ে অঝোরে পড়ে বৃষ্টির পানি।

সাব্বির আলম বাবু/ইবি টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »