চরফ্যাসন (ভোলা) : ভোলা চরফ্যাসনের ঢালচর ইউনিয়নে মেঘনার ভাঙনে আশ্রয়হীন গৃহহারা ১৫শ’ ভূমিহীন পরিবারের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। প্রমত্তা মেঘানা ভাঙনে প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঢালচর ইউনিয়ন।
প্রায় ৩৫ বছর ধরে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্ট ঘুরে সরেজমিনে সীমানা নির্ধারণ করে ভূমিহীন কৃষকদের জমি বুঝিয়ে দেয়ার দ্বারপ্রান্তে এলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় ঝুলে গেছে সেই ৪২শ’ একর জমির বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া। ফলে মাথা গোঁজার শেষ ঠিকানা নিশ্চিত করতে না পেরে ঢালচরের ১৫শ’ আশ্রয়হীন পরিবার উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে থানা সদরের স্বজনদের বাড়ি বাড়ি কিংবা বেঁড়িবাধের ঢালে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বন বিভাগের জবর দখলের কারনে ক্ষোভ বাড়ছে গৃহহারা ভূমিহীন পরিবারের মাঝে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, সাগর মোহনার ঢালচর ২০১০ সনে চরফ্যাসন উপজেলার ১৯ নং ইউনিয়ন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ ইউনিয়নের মর্যাদা পাওয়ার পর প্রমত্তা মেঘনা ঢালচরের প্রতি বিরূপ হয়। মেঘনার থাবায় গত একদশকে ঢালচরের ১ থেকে ৬ নম্বর ওয়ার্ড নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু অংশ আর ৯ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ঢালচর ইউনিয়নটি এখনও টিকে আছে। দুই-তৃতীয়াংশ মেঘনায় বিলীন হলেও গোটা ঢালচরের ১৭শ’ পরিবারের ১৮ হাজার মানুষ এখন ৭ থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত এই ৩টি ওয়ার্ডে ভীড় করেছে। কিন্ত এখানে এ পরিমান জনবসতির সংকুলান যেমন সম্ভব নয় তেমনি এখানে তাদের নিজস্ব কোন জমিও নেই। ভূমিহীন কৃষকদের নিজস্ব জমি না থাকলেও ঢালচর থেকে তারুয়া পর্যন্ত প্রায় ৪২শ’ একর জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
মেঘনার ভাঙ্গনে গৃহহীন ভূমিহীন পরিবারগুলোর পরিত্যক্ত চাষযোগ্য ৪২শ’ একর জমিতে নিজেদের অধিকারের দাবী নিয়ে ৩৫ বছর ধরে হাইকোর্ট থেকে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ফিরছে।
ঢালচরের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম হাওলাদার জানান, ঢালচর থেকে তারুয়া পর্যন্ত জেগে উঠা চাষযোগ্য ৪২শ’ একর জমির বয়স প্রায় ৫০ বছর। অর্ধশত বছর আগে জেগে উঠা বিশাল বিস্তৃত এই জমি নিজেদের দাবী করে বনবিভাগ আটকে রাখলেও কোন বনায়ন করেনি,এখন চাষযোগ্য এই জমি বনায়নের যোগ্যও নয়।
এছাড়াও পূর্ব ঢালচরে ১৫শ’ একর জমি কৃষকদের নামে বন্দোবস্ত দেয়া হলেও বনবিভাগের হামলা মামলার কারণে কৃষকরা সেই জমিতে যেতে পারেনি। পাশাপাশি বনবিভাগও সেই জমিতে বনায়ণ করেনি,এখন বনায়নের যোগ্যও নয় ওই জমি।
ভূমিহীন কৃষক আব্দুল কালাম মেম্বার জানান,ঢালচরের পূর্বাংশ মেঘনায় ভাঙ্গনের ফলে গৃহহীন ১৫শ’ পরিবার দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালচরের পরিত্যক্ত চাষযোগ্য ২৭শ’ একর জমি বন্দোবস্ত চেয়ে আসছে। বনবিভাগের বাঁধার কারণে ভূমিহীন কৃষকরা ১৯৮৬ সনে ভোলা সাব জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। দ্বীর্ঘ শুনানীর পর ১৯৯০ সনে ঢালচর চর সত্যেন যৌথ ভূমিহীন কৃষক সমবায় সমিতির পক্ষে রায় প্রদান করেন। ১৯৯২ সনে বনবিভাগে হাইকোর্ট এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করলে আপীল বিভাগ মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ১৯৯৭সনেই চরফ্যাসন সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে প্রেরণ করেন। এই আদালত ২০১৯ সনে দুই তরফা সূত্রে ভূমিহীন কৃষকদের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেয়ার জন্য রায় প্রাদন করেন। এই রায়ের প্রেক্ষিতে ২০২০ সনে ২৭২৭.২৭ একর জমি ভোলা জেলা প্রশাসক ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ওই জমি বন্দোবস্ত প্রদানের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ প্রাপ্তির পর চরফ্যাসন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঢালচরের ৪২শ’ একর জমির সীমানা নির্ধারণ করে বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া শুরু করেন। সে সময় কিছু কিছু ভূমিহীন কৃষক পরিবার ওই জমিতে ঘর নির্মাণ করে বসতি শুরু করেন।
এই বসতি উচ্ছেদের জন্য বনবিভাগ ওই পরিবারগুলোর ওপর হামলা ও মামলা দিয়ে নানান ভাবে আতংক সৃষ্টি করেন। বসতিগড়ার এই প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত করতে বরিশাল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তফিকুল ইসলাম স্থানীয় ভূমি প্রশাসনসহ ভূমিহীন কৃষকদের জড়িয়ে ভোলা জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন। এই অভিযোগকে পূজিঁ করে বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া স্থগিত করেন ভোলা জেলা প্রশাসক। সে থেকে ঢালচরের চাষযোগ্য ২৭শ’ একর এবং পূর্ব ঢালচরের চাষযোগ্য ১৫শ’ একর জমি পরিত্যক্ত পড়ে আছে,যা বন বিভাগের কোন কাজে লাগেনি আবার ভূমিহীন গৃহহীন কৃষকদেরও আশ্রয়ের ঠিকানা হতে পারেনি।
ঢালচরের বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আলাউদ্দিন জানান, পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালচরে ৪২শ’ একর খাসজমি পরিত্যক্ত আছে, যেখানে ঢালচরের মেঘনার ভাঙ্গনে আশ্রয়হীন সব পরিবারের বসতি সম্ভব। কিন্ত বনবিভাগের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সিন্ধান্ত ছাড়া আমার একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না।
চরফ্যাসন উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভুমি) রিপন বিস্বাস জানান, বিষয়টি নিয়ে যেহেতু ভুমি মন্ত্রণালয় ও বনমন্ত্রণালয়ের টানাপোড়ন রয়েছে। সেহেতু উভয় মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মতে আমরা যে নির্দেশনা পাবো সে অনুযায়ী কাজ করে যাবো।
জামাল মোল্লা /ইবি টাইমস