বাংলাদেশ ডেস্কঃ উন্নয়নশীল দেশের জোট ডি- ৮ এর দশম শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক এবং জোটের নতুন সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটের সদস্য দেশসমূহের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরও সহজতর করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের উন্নতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের সভাপতিত্বে ডি – ৮ জোটের এই শীর্ষ ভার্চুয়াল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী সদস্য দেশসমূহের রাস্ট্র ও সরকার প্রধানদের উপস্থিতিতে এই শীর্ষ সম্মেলনটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। করোনা মহামারীর জন্য পরবর্তীতে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই শীর্ষ সম্মেলনটি বাংলাদেশের নেতৃত্বে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উন্নয়শীল ৮টি মুসলিম দেশের জোট ডি-৮-এর দশম শীর্ষ ভার্চুয়াল সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছ থেকে আগামী ২ বৎসরের
জন্য সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই গুরুত্ব আরোপের কথা ব্যক্ত করেন। ডি- ৮ ভুক্ত দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, ইরান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, নাইজেরিয়া, মিশর ও ইন্দোনেশিয়া। সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানসহ সদস্য দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দীন ইয়াসিন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইরমান খান, মিশরের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা মাতবুলি এবং নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিওফ্রে ওনিয়েমা এইভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছেন,জোটের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ডি-৮ এর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সম্মিলিতভাবে একসাথে কাজ করার অনুরোধ করেছেন। সভাপতির উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দিতে ডি-এইট সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গারা যেন তাদের নিজ আবাসভূমি রাখাইনে স্বেচ্ছায় সম্মানজনক ও স্থায়ীভাবে ফিরে যেতে পারে সে বিষয়ে আমারা শুরু থেকেই জোর দিয়ে আসছি। এই সঙ্কট যেন আরো গভীর না হয় সেজন্য আমরা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা ডি-৮ জোটের সদস্য দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তারা এই ইস্যুতে আমাদের সমর্থন দিয়ে আসছে। আমরা আশা করছি, মিয়ানমার খুব শীঘ্রই তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে।
সম্মেলনে সমন্বিত উন্নয়নে ৪টি সম্ভাবনাময় খাত উপস্থাপন করেন সম্মেলনের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেগুলো হলো- দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে তরুণদের সক্ষমতা কাজে লাগানো; তথ্য-প্রযুক্তির আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিকসহ পূর্ণ সক্ষমতার ব্যবহার; অবকাঠামোগত কাঠামো তৈরি; বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সহজীকরণে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
জলবায়ু ইস্যুতে ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার সহযোগিতা বাড়ানোর অত্যাবশ্যকতা সামনে আনেন প্রধানমন্ত্রী। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন তিনি।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে ব্যবসায়ীদের ভিসা সহজ করার ওপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সম্ভাবনার তথ্য সরবরাহের পাশপাশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে মিয়ানমারের উপর চাপ অব্যাহত রাখা এবং করোনা মহামারী মোকাবেলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে অংশীদারিত্ব: যুবশক্তি ও প্রযুক্তির প্রস্তুতি’ শীর্ষক চার দিনব্যাপী এই ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক বাংলাদেশ। আগামী দুই বছর জোটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ। এই সম্মেলনে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে বর্তমান সভাপতি তুরস্ক।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই শীর্ষ ভার্চুয়াল মিটিংয়ে তার বক্তব্যের শুরুতেই প্রায় দুই দশক আগে তুরস্কের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নেমমেটিন এরবাকান দ্বারা উন্নয়শীল ৮টি মুসলিম দেশের জোট ডি-৮ এর প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন।
এই ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই অঞ্চলের বিশাল যুব সম্পদকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য সর্বোত্তম ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছেন। খান বলেন, “আমাদের ডি -৮ দেশে ৫৫০ মিলিয়ন যুবকের সংখ্যা রয়েছে। আমাদের যুবসমাজ কেবল আমাদের সুযোগগুলি অনুকূল করতে পারে না তবে আমাদের সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলিও কাটিয়ে উঠতে পারে।” তিনি আরও যোগ করে বলেন যে, এই বিশাল যুব সমাজের মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী উদ্ভাবক, প্রযুক্তি অগ্রদূত, শিক্ষাবিদ, কর্মী, শিল্পী এবং সাংবাদিকরা।
তিনি বলেন, “আমাদের জনগণের এই প্রধান উপাদানটির জন্য আমাদের অবশ্যই নতুন সুযোগ তৈরী করতে হবে,” তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তিকে জোড় করা, উদ্ভাবনের প্রচার করা, যুবকদের শিক্ষা, দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করা খুবই জরুরী একটি বিষয়। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আরও বলেন,”২০৩০ সালের মধ্যে ইন্ট্রা ডি -৮ বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমানে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে অর্জন করার জন্য আমাদের অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তিনি সীমানা পদ্ধতি সহজীকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক যোগসূত্র বাড়ানো, এবং ডি – ৮ দেশসমূহের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য নতুন উদ্যোগ পরিচালনারমতো পদক্ষেপের উপরেও জোর দিয়েছেন। “আমরা ডি – ৮ পেমেন্ট কার্ডের মতো ধারণাগুলি স্বাগত জানাই, যা স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন সক্ষম করে।”
এই শীর্ষ ভার্চুয়াল মিটিংয়ে ইরানের রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি তার বক্তব্যে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদার করার জন্য ডি – ৮ সদস্য দেশগুলির মধ্যে একটি মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি। তাছাড়াও “রূপান্তরকরণ এবং ব্যবসায়ের মিথস্ক্রিয়ার(পারস্পরিক আদান-প্রদান) কার্যকর অবস্থান থেকে আমরা প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে মুক্ত আঞ্চলিক বাণিজ্যের ভিত্তি স্থাপন করছি এবং শীঘ্রই আমরা প্রথম মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চল ইউরেশিয়ান দেশগুলির সাথে একত্রিত হব বলে জানিয়েছেন তিনি।
রুহানি আরও বলেন: “ভৌগলিক বিচ্ছুরণের পরেও ডি-৮ জোটটি আন্তঃসমাধ্যম, মানবিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ, জ্বালানি মজুদ, পরিপূরক অর্থনীতি এবং আগ্রহী বেসরকারী খাতগুলির বিশাল ক্ষমতা এবং অনুগ্রহ উপভোগ করছে।”
ইরানি নেতা বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান ইসলাম ফোবিয়া অর্থাৎ ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার কথারও উল্লেখ করেছেন। বিশ্বব্যাপী সংগঠিত ইসলামফোবিয়া কেবল ইসলামের উৎসাহিত মূল্যবোধকেই টার্গেট করে না, বরং মুসলিম দেশগুলির জন্য বিপরীত অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক পরিণতিও ডেকে আনছে।
ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমি এই ঘোষণা দিয়ে গর্বিত যে আমেরিকা ইরানের মহান জাতিকে তার আয়ত্বে আনার লক্ষ্যে অবৈধ এবং একতরফা সকল ব্যবস্থা গ্রহণের পরও ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন,ইরান প্রচুর অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থেকেও নিজেদের ইচ্ছাশক্তি এবং ঘরোয়া শক্তি দ্বারা মহামারী কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই করে দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন এবং গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি নামে পরিচিত যৌথ বিস্তৃত পরিকল্পনায় (জিসিপিওএ) ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন,”মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই জেসিপিওএ-তে ফিরে যেতে হবে,ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাগুলি তুলে নিয়ে বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এবং পারস্পরিক ঐক্যের ভিত্তিতে। আর তখনই কেবল ইরান সরকার তার পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করে মার্কিন পদক্ষেপে সাড়া দিবে।
এদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ডি-৮ এর কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়, বুধবার পরিষদের ভার্চুয়াল সভায় তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেবলুৎ সাবুসোলুর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন মোমেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সভাপতিত্বে বুধবার কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের ১৯তম সভায় ডি-৮ ভুক্ত দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা বক্তব্য দেন।
সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, বাংলাদেশ ১৯৯৯-২০০১ মেয়াদে সফলভাবে ডি-৮ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। দুই দশক পর দ্বিতীয়বারের মতো ডি-৮ এর সভাপতির দায়িত্ব নেবে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, “জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ এলডিসি গ্রুপ থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে পূরণ করেছে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে ডি-৮ এর সভাপতিত্ব লাভ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত আনন্দের”। বৈঠকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুব সমাজকে সহায়তা করতে ডি-৮ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আহ্বান জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “যেহেতু ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী প্রয়োজন, সেহেতু এ সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে তাদেরকে সহায়তার লক্ষ্যে ডি-৮ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।”
২০২২ সালের প্রথমার্ধে কাউন্সিল অব মিনিস্টার্সের পরবর্তী সভা আয়োজনের বিষয়ে আশা প্রকাশ করেন নতুন সভাপতি মোমেন।
বা ডে/ব্যবস্তাপনা সম্পাদক