আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ করোনায় আক্রান্ত হয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা, লোকসংগীত শিল্পী ও গবেষক ইন্দ্রমোহন রাজবংশী মারা গেছেন।
বুধবার ৭ই এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে তাঁর শ্যালিকা শিপ্রা ঘোষ। গণমাধ্যমকে তিনি আরও জানান, ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর স্ত্রী দীপ্তি রাজবংশীও অসুস্থ। তাছাড়াও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, তিনি করোনা ভাইরাসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। সোমবার হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। এর আগে ইন্দ্রমোহন রাজবংশী মহাখালী ও মালিবাগের দুটি হাসপাতাল চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে।জানিয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ফকির আলমগীর।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার শারীরিক অসুস্থ বোধ করলে শুরুতে ইন্দ্রমোহন রাজবংশীকে ঢাকার মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করানো হয়। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় তাঁর ফলাফল পজিটিভ হয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বুকের সিটিস্ক্যান রিপোর্টে বরেণ্য এই সংগীতজ্ঞের ফুসফুসে ৮৫ ভাগ ইনফেকশন ধরা পড়ে। এরপর অপেক্ষাকৃত উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার আরেকটি হাসপাতালে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে হাসপাতাল বদল করে দুদিন আগে তাঁকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করানো হয়। আজ সকালে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
ইন্দ্রমোহন রাজবংশী ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদিসহ বিভিন্ন ধরনের গান গাইতেন। তিনি সরকারি সংগীত কলেজে লোকসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তিনি বাংলাদেশ লোকসংগীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা। চলচ্চিত্র, বেতার ও টেলিভিশন অনেক গান গেয়েছেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ‘চেনা-অচেনা’ চলচ্চিত্রের গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক শুরু করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ইন্দ্রমোহন রাজবংশী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মনস্থির করেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় সম্মুখ যুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করতে পারেননি। পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের উপর অকথ্য নির্যাতন করায় ইন্দ্রমোহন রাজবংশী নিজের নাম–পরিচয় গোপন করে পাকিস্তানিদের দোভাষী হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন।
পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে চলে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গাওয়া শুরু করেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। গান গাওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকগান সংগ্রহ করতেন তিনি। এক হাজারেরও বেশি কবির লেখা কয়েক লাখ গান সংগ্রহ করেছেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে একুশে পদক লাভ করেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী।
ইন্দ্রমোহন রাজবংশী ১৯৪৬ সালের ২৬ শে জানুয়ারী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে, রাজবংশী তাঁর দাদা কৃষ্ণ দাস রাজবংশীর অধীনে সংগীত চর্চা শুরু করেছিলেন। তিনি যাত্রা, পালাগান, নজরুল সংগীত এবং লোকসঙ্গীতের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৬০ এর দশকের শেষদিকে তিনি নজরুল গানে বুলবুল ললিতাকলা একাডেমিতে ভর্তি হন এবং পাঁচ বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন।
১৯৬৩ সালে তিনি হাফিজুর রহমানের অধীনে লোকসঙ্গীত শিখতে শুরু করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে সরকারী কলেজের সংগীত শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন।
তাছাড়াও তিনি ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ লোক সংগীত পরিষদ একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটি দেশের ঐতিহ্যবাহী লোক গানের অনুশীলন, সংরক্ষণ, প্রচার এবং গবেষণা করে থাকে। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের গান সহ শিশুদের জন্য প্রায় ১০০ টি লোকসঙ্গীত রচনা করেছেন। তিনি আর্টস অ্যান্ড কালচার অফ এক্সচেঞ্জের দ্য অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়ার্ল্ড মাস্টার্সের চেয়ারপার্সন কিম সং ওকের কাছ থেকে তাঁর ওয়ার্ল্ড মাস্টারের সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন।
তিনি দুই সন্তানের জনক; ছেলে দীপংকর রাজবংশী থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়, মেয়ে সংগীতা রাজবংশী থাকেন জাপানে। তার স্ত্রী দীপ্তি রাজবংশীও বর্তমানে অসুস্থ।
তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শোক প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অষ্ট্রিয়া প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ বায়েজিদ মীর এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ইউরো বাংলা টাইমসের এডিটর-ইন- চিফ মাহবুবুর রহমান । উভয়ে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান ।
কবির আহমেদ /ইবি টাইমস