অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট

অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই

পর্ব-৮ 

ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (৭১) ১৯৭৫ -এর পরবর্তী ঘটনাবলীর পর সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিঃসন্দেহে খন্দকার মোশতাক আহমেদের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। তাই ১৫ই আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর মাত্র ৬ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০শে আগস্ট তিনি (মোশতাক আহমেদ) সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে সরিয়ে দেন এবং তদস্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উক্ত পদে নিয়োগ দান করেন। নিজে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরকে বিচারের আওতায় না এনে বরং তাদেরকে রক্ষা করার জন্য ঐ বছরের ২৬শে সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক কুখ্যাত Indemnity Ordinance জারি করেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উপরোক্ত চরম অমানবিক অধ্যাদেশটিকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমান আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সহিত জিয়াউর রহমানের পূর্বাপর জড়িত ও সম্পৃক্ততার বিষয়টি জনসমক্ষে প্রমাণ হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিচার প্রক্রিয়া সাংবিধানিকভাবে বন্ধ রাখার জন্যই জেনারেল জিয়া উপরোল্লিখিত বর্বরোচিত অধ্যাদেশটিকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন বলে সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়।

(৭২) পৃথিবীর যে কোন একটি সভ্য এবং গণতান্ত্রিক দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি দেশের স্থপতি এবং প্রেসিডেন্টকে সপরিবারে হত্যাকারীদেরকে বিচারের আওতায় আনা রাষ্ট্রের নৈতিক এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ বর্বর খুনীদেরকে বিচারের আওতায় আনার পরিবর্তে তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষা এবং অব্যাহতি দেয়ার জন্য কুখ্যাত Indemnity Ordinance জারি করেন। আবার তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে উক্ত অধ্যাদেশটিকে সংবিধানের অংশ করে নেন মোশতাক আহমেদ কর্তৃক নিয়োজিত সেনাপ্রধান এবং পরবর্তীকালে সেনাপ্রধান হিসেবেই রাষ্ট্রপতির পদ দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাই এই নৈতিকতা বিবর্জিত কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি (জিয়াউর রহমান) বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সহিত পূর্বাপরই জড়িত এবং সম্পৃক্ত ছিলেন বলে আবহমান কাল ধরেই অভিযুক্ত হবেন এবং চিত্রিত হবেন। বাংলা সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় এবং সুপ্রসিদ্ধ বাগধারা হচ্ছে “চোরে চোরে মাসতুত ভাই”। তাই খুনী এবং খুনী মিলে কেমন ভাই সে প্রশ্নের জবাব আমাদের বিবেকের তাড়নাতে আমাদেরকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।

(৭৩) বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী মনযোগ সহকারে পাঠ করলে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, তিনি (শেখ মুজিব) বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার পেছনে নিরবে, নিভৃতে সাহস যুগিয়েছেন এবং প্রেরণা দিয়েছেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। দেশ ও জাতির চরম দুর্দিনে এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এসেছে তাঁর কাছ থেকে। মাত্র ৪৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনেও তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রেরণার বাতিঘর। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা সহধর্মিণীই ছিলেন না বরং ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্য সার্বক্ষণিক একজন সংবেদনশীল রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। পঁচাত্তরের কালরাত্রিতে খুনীদের কাছে তিনি তাঁর প্রাণভিক্ষা চাননি। তিনি নিজে বাঁচতেও চাননি। বরং অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বলেছেন – “আমার স্বামীকে হত্যা করেছ, আমি ও তাঁর কাছেই যাব। আমাকেও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দাও।” পাষণ্ড খুনীরা ঐ সময় তাঁকেও ব্রাশফায়ারে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রাণের গভীরে ধারণ করে তাঁর যোগ্য এবং উপযুক্ত সাথী হিসেবে তাঁর সাথেই তিনি অকাতরে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন এবং সহমরণ কে বেছে নেন। এহেন অসীম সাহসিকতার সাথে জীবন উৎসর্গ করার মতো চরম আত্মত্যাগ তথা প্রচণ্ড রকমের উৎসাহব্যঞ্জক এবং প্রেরণাদায়ক ঘটনার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।

(৭৪) বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী (beneficiary) দের দ্বারা জারিকৃত কুখ্যাত Ordinance টি বহাল এবং বলবৎ থাকায় এবং এই অধ্যাদেশটিকে আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার কারণে উক্ত হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে উপরোক্ত অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার খুনী এবং ষড়যন্ত্রকারী মোশতাক ও জিয়া চক্র এবং তাদের অনুসারী ও ভাবশিষ্য এরশাদ এবং খালেদা জিয়া বিগত ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সনের জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রায় ২১ বছর ধরে বিভিন্ন কূটকৌশলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। ফলে এই সময়কাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করতে হয়। একই কারণে উক্ত হত্যাকাণ্ডের বিচার ও বন্ধ থাকে। অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এবং মর্ম বিদারক হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা তো অনেক দূরের কথা বরং পাষণ্ড খুনীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন জেনারেল জিয়া। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ১২ জনকে বিশ্বের বিভিন্ন দূতাবাসে শীর্ষ পদে চাকরি দিয়েছেন জিয়া। এটি নিঃসন্দেহে ছিল জিয়ার তরফ থেকে বঙ্গবন্ধুর বর্বর খুনীদেরকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।

(৭৫) বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের আনুপূর্বিক ঘটনাবলী তদন্ত করার জন্য তৎকালীন বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাবস্থায় তাঁকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল) -কে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে ঐ কমিটি বাতিল করে দেন। পরবর্তীকালে বৃটিশ এমপি টমাস উইলিয়ামকে প্রধান করে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই কমিশনের কাউকেই ঢাকায় আসার জন্য কোন ভিসা দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে জিয়াউর রহমানের কেন এবং কি কারণে এত অনিচ্ছা কিংবা অনাগ্রহ ছিল অথবা ভয় কিংবা আতংক ছিল তা তার উপরোক্ত নীতি বিগর্হিত কার্যক্রমের মাধ্যমে দিবালোকের মতো খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়।

(৭৬) দেশের স্বাধীনতার মহানায়ক এবং দেশের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং বর্বরোচিতভাবে হত্যা করার ঘটনাবলী অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করার মাধ্যম খুনীদেরকে বিচারের আওতায় আনা এবং তাদের যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা উত্তরসূরী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের নৈতিক এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে তিনি তা করেননি। উপরন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি তদন্ত কমিশনকে তিনি সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বাতিল করেছেন। এরই পাশাপাশি একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনকে দেশে আসতে না দিয়ে এবং তদন্ত করার কোন সুযোগ কিংবা অবকাশ না দিয়ে চরম অমানবিক এবং অনৈতিক আচরণ করেছেন। উপরোক্ত পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের সাথে তার জড়িত এবং সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার ভয়েই তিনি (জিয়া) এমন নীতি বিবর্জিত কাজ করেছেন বলে সামগ্রিক ঘটনাবলীর আলোকে অত্যন্ত জোরালোভাবেই প্রমাণিত হয়। একই কারণে তার (জিয়ার) এহেন চরম অনৈতিক, অমানবিক এবং অসহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে তার সরাসরি জড়িত এবং সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে (undoubtedly and trustworthily) প্রমাণিত হয়।

(৭৭) জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় থেকে গেলে কিংবা এই পদে অধিষ্ঠিত থেকেই তিনি অবসরে চলে গেলে কোন প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহের মধ্যে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান থেকে পদোন্নতি প্রদানের মাধ্যমে তাকে সেনাবাহিনী প্রধান করায় বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে তার পূর্বাপর যোগাযোগ এবং সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি দেশবাসীর নিকট উন্মোচিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতির দখল করে নেয়ায় ক্ষমতার প্রতি তার অবাঞ্ছিত মোহ এবং সুদূরপ্রসারী উচ্চাভিলাস দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। তারও পরে একাধারে রাষ্ট্রের তিন তিনটি শীর্ষ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ তথা সেনাবাহিনী প্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকাবস্থায় কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক দল (বিএনপি) গঠন করে উক্ত দলের প্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় তার দুর্দমনীয় ক্ষমতা লিপ্সা যে কোন প্রকার সন্দেহ ব্যতিরেকেই (Beyond all shadow of doubt and controversy) প্রমাণিত হয়।

(৭৮) বঙ্গবন্ধুর অন্ধ সমালোচক কিংবা আওয়ামী লীগ বিরোধী কোন না কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও নীতিহীন আনুগত্যের কারণে কেউ মানুন কিংবা না ই মানুন, একথা সত্য যে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগকারী ব্যক্তি ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাই তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া তো অনেক দূরের কথা বঙ্গবন্ধুর নামটি ও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করা যেত না। তদুপরি সরকারী বেতার এবং টিভিতেও তিনি অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিলেন। তাই জেনারেল জিয়ার আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাওয়া যায়নি। এমনকি জিয়ার অনিচ্ছা, অনাগ্রহ এবং অসহযোগিতার কারণে এই হত্যাকাণ্ডের কোন তদন্ত ও করা যায়নি। তাই এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের পেছনের রাজনৈতিক শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীদের তথা নেপথ্যের কুশীলবদেরকে চিহ্নিত করা এবং তাদের মুখোশ উন্মোচন করাও সম্ভব হয়নি। ফলে খুনীদের কাউকেই বিচারের সম্মুখীন ও করা যায়নি। রাজনীতিতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে জাতির পিতা এবং রাষ্ট্রপতির মতো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সপরিবারে হত্যা করার অপসংস্কৃতি চালু করা, খুনীদেরকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়া এবং তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা কতটা নীতি বিগর্হিত অপরাধ তা জিয়াউর রহমান কোনদিন বুঝতেই চাননি। এরই ফলশ্রুতিতে বিগত ১৯৮১ সনের ৩০শে মে দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থান কালে তিনি নিজেও অত্যন্ত নির্মম এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

(৭৯) জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি (অবঃ) আবদুস সাত্তার পদাধিকারবলে অস্থায়ী ভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় তথা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থেকেই তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং নির্বাচিত ও হন। এই নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নিমিত্তে বৈধতা প্রদানের জন্য আমাদের সংবিধানের ৬ষ্ঠ সংশোধনী আনয়ন করা হয়। যা ছিল নিতান্তই অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিতান্তই অপ্রত্যাশিতভাবে রাতের অন্ধকারে বয়োবৃদ্ধ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি (অবঃ) আবদুস সাত্তারের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ১৯৮২ সনের ২৪শে মার্চ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। পরে সুদীর্ঘ প্রায় নয়টি বছর ধরে দুর্দান্ত প্রতাপে তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন।

(৮০) অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো যে, জিয়াউর রহমানের মতো তার ভাবশিষ্য বিচারপতি সাত্তার এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ -প্রমুখদের কেউই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য সম্পাদন করার ব্যাপারে কোন প্রকার উদ্যোগ কিংবা কোন ভূমিকাই পালন করেননি। এই হত্যাকাণ্ডের কোন তদন্ত ও তাদের কেউই করতে দেননি। উপরন্তু তাদের পূর্বসূরী জিয়াউর রহমানের মতো তারাও ঘাতক খুনীদেরকে কখনো নেপথ্যে আবার কখনোবা প্রকাশ্যে সমর্থন যুগিয়েছেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এরশাদের শাসনামলে বিগত ১৯৮৬ সনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের একাধিক খুনীদের মধ্যে আত্মস্বীকৃত অন্যতম খুনী লেঃ কর্নেল (অবঃ) সৈয়দ ফারুক রহমান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এহেন অবস্থায় রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রটোকল ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়। যা শুধু অনৈতিক এবং অমানবিকই ছিল না, বরং ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক এবং মর্ম বিদারক। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো যে প্রচণ্ড গণ আন্দোলনের মুখে বিগত ১৯৯০ সনের ৬ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে এরশাদের স্বৈর শাসনের অবসান ঘটে।

(৮১) পরবর্তীকালে ১৯৯১ সনের ২৭শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো যে, এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুগ্রহ ভোগকারিনী খালেদা জিয়া ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরিবর্তে তার প্রয়াত স্বামীর পদাঙ্ক নীতিহীনভাবে অনুসরণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্য সম্পাদনে কোন উদ্যোগ কিংবা কোন পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে তিনি তার একাধিক সম্পূর্ণ মিথ্যা, কাল্পনিক এবং বানোয়াট জন্ম তারিখের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ভূয়া জন্মদিন হিসেবে ১৫ই আগস্টকে তার জন্ম বার্ষিকী পালনের জন্য উৎসবের দিন হিসেবে তিনি বেছে নেন। যা ছিল চরম অনৈতিক, প্রচণ্ড অমানবিক এবং অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। মিথ্যা জন্মদিন পালনের পাশাপাশি তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনী আজিজ পাশাকে পদোন্নতি দিয়ে তার চাকরি জীবনের সমুদয় পাওনা টাকা তিনি তদীয় স্ত্রীকে প্রদান করেন। তারও পরে অন্য এক খুনী খায়রুজ্জামানকে অবসর থেকে ডেকে এনে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেন এবং পদোন্নতি প্রদান করেন।

(৮২) পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের চরাই উৎরাই পেরিয়ে বিগত ১৯৯৬ সনের ১২ই জুন ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। এহেন অবস্থায় ১৯৭৫ -এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম এবং মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সনের ২৩শে জুন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রথম বারের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় আরোহণের অব্যবহিত পর তৎকালীন আইনমন্ত্রী কুখ্যাত Indemnity Ordinance -টি বাতিলের জন্য সংসদে বিল উত্থাপন করেন। পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, উক্ত বিল উত্থাপনের প্রতিবাদে বিএনপি সংসদ থেকে ওয়াক আউট করে। পরে এই বিলটি যেদিন সংসদে পাস হয়

সেদিন ও তারা (বিএনপি) সংসদ থেকে ওয়াক আউট করে। যা শুধুমাত্র ন্যাক্কারজনক নয় বরং চরমভাবে ধিক্কারজনক ও বটে। 

ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ), লেখক ও কলামিস্ট 

(চলবে) 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »