অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট

অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই 

পর্ব-৭ 

ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (৬১) সুশিক্ষিত এবং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই জানেন মহামতি কার্ল মার্ক্স কিংবা লেনিনের উচ্চমার্গীয় ফর্মুলার আলোকে নয় বরং বাংলাদেশে বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে এবং বাংলাদেশের নিজস্ব স্টাইলে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মহৎ, লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট এবং কর্মসূচী ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যুগান্তকারী। ফলে সমাজতন্ত্রের বিরোধী শক্তি এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের দেশগুলি বঙ্গবন্ধুর এহেন মহতী উদ্যোগ এবং কর্মসূচী সহজভাবে গ্রহণ করেনি। এমতাবস্থায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অপশক্তি গুলো আরও অধিক পরিমাণে বৈরী হয়ে উঠে। তারা বঙ্গবন্ধু সরকারকে যে কোন উপায়ে উৎখাত করার নিমিত্তে সর্ব শক্তি নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠে। এই লক্ষ্য নিয়ে তারা অত্যন্ত সঙ্গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে। এরই পাশাপাশি তাদের ষড়যন্ত্র ফলপ্রসু করার নিমিত্তে অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর এবং তাঁর সরকারের ফাঁক-ফোকর সন্ধান করতে থাকে এবং তা কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠে।

(৬২) বর্তমান বাস্তবতার আলোকে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের পক্ষে ছিল না। বরং তারা ঐ সময়ে আমাদের প্রতি চরম বৈরী ছিল। এছাড়া পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে সৌদী আরব এবং সৌদী বলয়ের আরও একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের প্রতি চরম বিরূপ ছিল। তাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত সমস্যার সম্মুখীন হলেও ঐ সমস্ত দেশগুলো আমাদের সাহায্যে কিংবা সমর্থনে কোনভাবেই এগিয়ে আসেনি। এহেন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসুচী ঘোষণা করায় ঐ সমস্ত দেশ এবং তাদের এদেশীয় দোসররা কঠোর গোপনীয়তার সাথে এবং নিত্য নতুন কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

(৬৩) প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক যে, পূর্ব নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য দিন ধার্য ছিল। ঐ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধুর আসার প্রোগ্রাম ছিল। এছাড়া নবগঠিত বাকশাল কর্মসূচীর প্রেক্ষিতে দেশের ৬৪টি জেলার গভর্নরদেরকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ও ঐ দিন ধার্য ছিল। এহেন অবস্থায় সারা দেশ এবং জাতি উপরোল্লিখিত কর্মসূচীর দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল এবং অপেক্ষমাণ ছিল। আর এহেন একটি যুগান্তকারী ও সুদূরপ্রসারী কর্মসূচী উদ্বোধনের কয়েক ঘণ্টা পূর্বে তথা ১৫ই আগস্ট প্রত্যুষে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ মদদে বিভ্রান্ত এবং পথভ্রষ্ট কতিপয় উচ্চভিলাসী নরপশু অত্যন্ত বর্বর এবং পাশবিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। উন্মত্ত ঘাতকদের এহেন বিবেকবর্জিত এবং দানবীয় কর্মকাণ্ডের পৈশাচিকতা মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত এবং জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের নির্মমতায় আমরা হারালাম আমাদের অকৃত্রিম সুহৃদ এবং স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে।

(৬৪) নেপথ্যের কুশীলবদের অব্যাহত প্ররোচনা, নজিরবিহীন পৃষ্ঠপোষকতা, সক্রিয় সহযোগিতা এবং সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল (অবঃ) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং তার ভায়রা ভাই লেঃ কর্নেল (অবঃ) খন্দকার আবদুর রশীদের নেতৃত্বে বর্বর ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে বলে তারা নিজেরাই বিবিসি সহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে অসংকোচে এবং অকপটে স্বীকার করেছেন। দেশবাসী অবশ্যই জানেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। এরই পাশাপাশি ঐ সময়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মধ্যে অন্যতম খুনী লেঃ কর্নেল (অবঃ) ফারুক রহমান এবং লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবদুর রশীদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন অভ্যুত্থানের ব্যাপারে তারা জেনারেল জিয়ার সাথে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তারা জেনারেল শফিউল্লাহর সাথে কোন আলোচনা করেছেন বলে কোন সাক্ষাৎকারেই বলেননি। উপরোক্ত আলোচনার সময়ে জিয়াউর রহমান তাদেরকে বলেছেন- “Go ahead.”

(৬৫) দেশের উপ প্রধান সেনাপতি হিসেবে তার চেয়ে জুনিয়র এবং অবসরপ্রাপ্ত মধ্যম শ্রেণীর অফিসারদেরকে go ahead না বলে তাদেরকে যে কোনভাবে নিবৃত্ত করা অথবা গ্রেফতার করা জিয়াউর রহমানের উচিত ছিল। অন্যথায় এ ব্যাপারে তার ঊর্ধতন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অথবা আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থাকে তার জানানো উচিত ছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে জেনারেল জিয়ার নিজের এবং তার স্ত্রীর অবাধ যাতায়াত ছিল বিধায় এতদসংক্রান্ত ব্যাপারে তারা সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে অথবা তাঁর পরিবারের অন্য কোন সদস্যকে এ ব্যাপারে অবগত এবং অবহিত করতে পারতেন। আর এটিই তার নৈতিক এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল। কিন্তু স্বীকৃত মতেই তিনি তা করেননি। আর তা না করায় তিনি (জিয়াউর রহমান) স্বেচ্ছায় এবং সজ্ঞানে আইন ভঙ্গ করেছেন এবং শপথ ও ভঙ্গ করেছেন। আর এহেন আইন এবং শপথ ভঙ্গ করার মাধ্যমে তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অমার্জনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এরই পাশাপাশি ১৫ই আগস্টের পাপিষ্ঠ হত্যাকারীদেরকে স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে মদদ দিয়েছেন বলে সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়।

(৬৬) প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক Lorence Lifshulze ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টে হংকং থেকে প্রকাশিত Far Eastern Economic Review ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি ছিলেন। এছাড়া তিনি Guardian পত্রিকায় ও নিয়মিত লেখক ছিলেন। Dhaka Tribune -এর সম্পাদক জাফর সোবহানের সঞ্চালনায় গত ২১-০৮-২০২০ ইং তারিখে Center for Research and Information (CRI) -কর্তৃক আয়োজিত “Bangladesh 1975: Setting the clock back” – শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে উপরোক্ত অনুসন্ধানী সাংবাদিক Lifshulze নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেন। তিনি তার বক্তৃতায় ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড, অভ্যুত্থান এবং এতে জিয়াউর রহমান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে অনেক অজানা তথ্য সামনে নিয়ে আসেন। আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীকালে সংঘাতময় নভেম্বরের ঘটনাবলী অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রখ্যাত এই মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জিয়াকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত একজন ব্যক্তি’ অভিহিত করে বলেন, “তিনি অরাজকতার মাধ্যমে অনেকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। জিয়ার সমর্থন ছাড়া এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব ছিলনা। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়াও জিয়াউর রহমান এমন কাজ করতে পারেননি।”

Lifshulze তার বক্তৃতায় আরও বলেন- “জানতে পারি যে ক্যু -এর ঘটনার কিছুদিন আগে মার্কিন দূতাবাসের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সেখানে সি আই এর পক্ষ থেকে তাকে গোপন বার্তা দেয়া হয়। ঢাকায় সি আই এর স্টেশন প্রধান ফিলিপ চেরির সঙ্গেও জিয়া একান্ত বৈঠক করেন। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টার এই ক্যু -এর পরিকল্পনায় খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তখন তিনি মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের এই পরিকল্পনা প্রকাশ না করার জন্য নির্দেশ দেন। ক্যু -এর ঘটনার ছয় মাস আগে এই পরিকল্পনা হয়। ক্যু -এর আগে বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডিনারের আয়োজনে জিয়া সি আই এর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জিয়াউর রহমান এই ক্যু -এর অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন।”

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা ছয় মাস আগে হয়েছিল দাবি করে তিনি (Lifshulze) বলেন, “পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় এক সপ্তাহ আগে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় জিয়া অন্য সৈন্যদেরকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যেতে দেননি। সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে তিনি হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে কোন ব্যবস্থা নেননি। বরং এই ক্যু -এর বিরুদ্ধে যাতে কেউ অবস্থান না নেয় তিনি তা নিশ্চিত করেন। জিয়া ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার কেন্দ্রে [সূত্রঃ জিয়ার সমর্থন ছাড়া সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্ভব ছিল না– স্টাফ রিপোর্টার, জনকণ্ঠ, ২২-০৮-২০২০]।”

(৬৭) ফারুক রহমান এবং আবদুর রশীদের সাথে বৈঠকের ব্যাপারে বিগত ১৯৭৬ সালে লন্ডনের ITV চ্যানেলের World in Action প্রোগ্রামে সাংবাদিক Anthony Mascarenhas কে দেয়া সাক্ষাৎকারে লেঃ কর্নেল (অবঃ) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেঃ কর্নেল (অবঃ) খন্দকার আবদুর রশীদ বলেছেন- “বঙ্গবন্ধু হত্যা ও চক্রান্তের বিষয়ে ১৫ই আগস্টের বহু পূর্বেই তারা জিয়াকে অবহিত করেছেন। ফারুক জানান, ২০শে মার্চ ১৯৭৫ এর সন্ধ্যা ০৭-৩০ মিনিটের দিকে সে জিয়ার বাসায় জিয়ার সাথে দেখা করে এবং তাকে বলে- The country requires a change. উত্তরে জিয়া বলেন, Yes yes. Let’s go outside and talk. সেখানে ফারুক পুনরায় বলেন, We have to have a change. We the junior officers have already worked it out, we want your support and leadership. জিয়া বলেন, If you want to do something, you junior officers should do it yourself…” [Anthony Mascarenhas, Bangladesh: A Legacy of Blood, Page 54, Hodder and Stroughton, London, 1986] [সূত্রঃ অপরাধীরা রেহাই পেতে পারেনা- প্রফেসর ড. রেবা মন্ডল; ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া; জনকণ্ঠ, ৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২০]।”

(৬৮) ১৫ই আগস্ট উপলক্ষে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ-এ ঐদিন গত রাতে প্রণব সাহা অপুর সঞ্চালনায় একটি টক শো অনুষ্ঠিত হয়। ঐ টক শোতে অন্যান্যদের সহিত অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বাংলাদেশী অধ্যাপক ড. শামস রহমান সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকেই অনলাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত হন। ১৯৭৫ সনের ২০শে মার্চ লেঃ কর্নেল (অবঃ) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেঃ কর্নেল (অবঃ) খন্দকার আবদুর রশীদ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাত করে তাদের পরিকল্পিত সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেছেন বলে বিগত ১৯৭৬ ইং সনে প্রদত্ত তাদের সাক্ষাতকারে তারা অত্যন্ত পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন (clearly and categorically) ভাষায় স্বীকার করেছেন বলে অধ্যাপক শামস রহমান উপরোক্ত টক শোতে ব্যক্ত করেন। ফারুক-রশীদের সাক্ষাতকার এবং স্বীকারোক্তির ব্যাপারে Mascarenhas তার বইয়ে ও বিবৃত এবং বিধৃত করেছেন বলে উপরোক্ত প্রফেসর একই টক শোতে উল্লেখ করেন। এমনকি জিয়াউর রহমান ১৫ই আগস্টের হত্যাকারীদের মূল ষড়যন্ত্রকারীদের একজন বলে ও প্রফেসর শামস রহমান সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে সম্পৃক্ত হয়ে অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ব্যক্ত করেন।

(৬৯) ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিগণ জানেন রোম যখন পুড়ছিল রোমের সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। আমাদের বাংলাদেশের নরপিশাচ খুনীরা যখন বঙ্গবন্ধুর বাসায় বর্বরোচিতভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতেছিল তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দাঁড়ি শেভ করছিলেন বলে তৎকালীন কর্নেল শাফায়েত জামিল বার বার তার সাক্ষাতকারে বলেছেন। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চলাকালে তিনি (শাফায়েত জামিল) রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নং সাক্ষী হিসেবে আদালতে যথারীতি সাক্ষ্য ও প্রদান করেছেন। তিনি তার উপরোক্ত সাক্ষাৎকারে আরও বলেছেন বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার সংবাদ শোনার পর জিয়াউর রহমান বলেন- “So what? President is killed but the vice president is there. He will take over and uphold the constitution. [সূত্রঃ জিয়াই ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল হোতা- বিচারপতি এই এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, জনকণ্ঠ, ১৫ই আগস্ট, ২০১৮]।”

সুতরাং অত্যন্ত হৃদয়বিদারক হলেও সত্য যে, দেশের জাতির পিতা এবং রাষ্ট্রপতি নিহত হওয়ার সংবাদ শোনার পর ও সেনাবাহিনীর উপপ্রধান কতটা নির্লিপ্ত, নির্বিকার এবং ভাবলেশহীন ছিলেন তা তার উপরোক্ত মন্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয়।

(৭০) শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাদের দেশের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি ঐ সময়ে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন এবং জীবিত ও ছিলেন। এরই পাশাপাশি ঐ দিন আমাদের জাতীয় সংসদ ও কার্যকর ছিল। অর্থাৎ সংসদ বাতিল করা হয়নি কিংবা স্থগিত ও করা হয়নি। সংসদের স্পীকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। তিনি ও সুস্থ ছিলেন এবং জীবিত ছিলেন। সুতরাং দেশের প্রেসিডেন্ট তথা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামেরই প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা। তিনি অক্ষম কিংবা অসমর্থ অথবা অপারগ হলে সংসদের স্পীকারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা। কিন্তু স্বীকৃত মতেই তাঁদের কেউই তা হলেন না। তাঁদেরকে by-pass কিংবা overtake করে প্রেসিডেন্ট হলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যা ছিল সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। সুতরাং স্বীকৃত মতেই খন্দকার মোশতাক আহমেদ সাংবিধানিক পথে নয়, বরং বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর পাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অবৈধভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ জবরদখল করে নেন।

 ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ) ,লেখক ও কলামিস্ট 

(চলবে) 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »