আজ ২৫ শে মার্চ, সেই ভয়াল কালরাত্রি

ইউরোপ ডেস্কঃ ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে প্রাণ নিয়েছিলো নিরীহ ও নিরস্ত্র হাজারো বাঙ্গালীর।

১৯৭১সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত এই গণহত্যা, যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১ এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত,যা ১৯৭০ এর নভেম্বরে সংঘটিত অপারেশন ব্লিটজ্‌ এর পরবর্তি অনুষঙ্গ রূপ।অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬শে মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

বাঙ্গালীরা তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারবে,তা পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের ধারণার বাইরে ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সকল বড় বড় শহরের পতন ঘটার মধ্যে দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান অংশ শেষ হয়। এই সামরিক আক্রমণ ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে ত্বরান্বিত করে। এই গণহত্যা সকল বাঙ্গালীদের ক্রুদ্ধ করে তোলে যে কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালি অফিসার ও সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং বহু মানুষকে শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়।

এই ভয়াবহ গণহত্যা ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং বাঙ্গালীরা দখলদারী পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতারিত করতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পরিণতিতে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড “মিত্র বাহিনী” এর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ, জাতীয় ও বিশ্বের অন্যতম একটি “গণহত্যা” দিবস হিসাবে  ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ইতিহাসে একটি ঘৃণ ও কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন আজ। রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ওই গণহত্যার মাধ্যমে মুক্তিকামী বাঙ্গালীর কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার এক ব্যর্থ ঞষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন শুরু হয়। ভয়াবহ ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্মরণ করে বাঙ্গালী জাতি।

‘অপারেশন সার্চ লাইট’ ছিল বাঙ্গালীর একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এক নারকীয় পরিকল্পনা। পোড়া মাটি নীতি নিয়ে নেমেছিলো পাকিস্তানি ঘাতকরা। সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাকিস্তানি নর ঘাতক জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না’। ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালী জাতির জীবনে নেমে এসেছিল এক বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত্রি।

রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে বাঙ্গালী নেতৃত্বের সঙ্গে ১৬ মার্চ থেকে আলোচনার নাটকের পর ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় হত্যাযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়ে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে বিমানে উঠে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ত্যাগ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে উঠে তার বর্বর সেনাবাহিনী।

২৫ মার্চের সেই রাতে নিরীহ ঢাকাবাসী যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। তাদের জলপাই রঙের ট্যাংকগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ-ইপিআর ব্যারাকের দিকে ধেয়ে যেতে থাকে। রচিত হয় এক কুখ্যাত ইতিহাস। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ-ট্রাক বোঝাই করে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্যাংকসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে আধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার।

ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লাশের পর লাশ। মধ্যরাতের ঢাকা তখন লাশের শহর। সোজাকথা সামনে যাকে পেয়েছে,তাকেই গুলি করে হত্যা করছে। তাই সে রাতে শহীদদের মধ্যে রিকসাওয়ালা এবং ঠেলাগাড়ি ওয়ালা অত্যন্ত নিরীহ ও নিরস্ত্র সাধারণবাঙ্গালীও ছিল।

সে রাতে সোয়া ১টার দিকে একদল সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে যায়। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে বাড়ির টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হয়।বাঙ্গালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাৎ করে দিতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যায় হায়েনার দল।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের সেই ভয়াল রাতে কত বাঙ্গালীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে- এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় নি । তবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার ভাষ্য, কেবল ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় একলাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।

কবির আহমেদ/ ইবি টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »