চলে গেলেন আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, রেখে গেলেন স্মৃতি

নিউজ ডেস্কঃ দৈনিক জনকন্ঠের সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ চলে গেলেন  না ফেরার দেশে । তাকে নিয়ে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন এক সময় জনকন্ঠের দাপুটে সাংবাদিক শরিফুজ্জামান পিন্টু,তার ফেইসবুক ফেইজে । পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হোল ।

তিনি আমার সম্পাদক ছিলেন- শরিফুজ্জামান পিন্টু                                                                     

এমন এক সময় সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ মারা গেলেন, যখন ছাঁটাই বন্ধ করা ও পদোন্নতিসহ নানা দাবিতে দৈনিক জনকন্ঠে অস্থিরতা চলছে। এরই মধ্যে তাঁর চলে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। সম্পাদক হিসেবে গৌরবোজ্জল শুরুটা ম্লান হওয়ার প্রেক্ষাপটে উনি চলে গেলেন।

অথচ বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় ঝাঁকুনি দিয়েছিল জনকন্ঠ। এই পত্রিকাটির প্রথম দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। দেশের পাঁচ জায়গা থেকে প্রথম প্রকাশ পাওয়া আধুনিক সংবাদপত্র। প্রখ্যাত সাংবাদিক তোয়াব খানের নেতৃত্বে সাংবাদিকতার সেই যাত্রা অনেকটাই থমকে গেছে।

২২ মার্চ সকালে বাসার বাইরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ওনার মৃত্যুর খবরটি জানতে পারি। এরপর অনেকক্ষণ বসেছিলাম। ভাবছিলাম, এমন একটি সময়ে উনি চলে গেলেন যখন আমার সাবেক অগ্রজ ও অনুজ সহকর্মী এবং এখন সেখানে কর্মরতদের অনেকেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এই সময়ে ওনাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করা কঠিন কাজ, তারপরও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসংখ্য স্মৃতি। আসলে একজন মানুষকে অল্প সময় বা শেষ সময় দিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত না—এই যুক্তিতে লিখতে বসি।

১৯৯৩ সালের মার্চ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রায় একযুগ জনকন্ঠে কাজ করেছি। পত্রিকাটি ছেড়ে আসার পর সম্পাদক আর আমার সঙ্গে কথা বলেননি। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওনাকে মোবাইল ফোনে ম‍্যাসেজ পাঠিয়ে স্যালুট জানাতাম, জবাব দেননি। কিন্তু সেজন্য ওনার প্রতি শ্রদ্ধা আমার কমেনি। কারণ আমার সঙ্গে কথা না বলার বিষয়টি ছিল ওনার অভিমান।

২০০৫ সালের অক্টোবরে যেদিন ওনার কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম, সেদিন তিনি আমাকে বিদায় দেননি। এক পর্যায়ে চেয়ার ঘুরিয়ে অন্যদিকে বসলেন। সেদিনের একটি কথাই শুধু মনে আছে। বলেছিলেন, নাক ফুল চেন? বললাম জ্বী স্যার। বললেন, তোমাকে এই প্রতিষ্ঠান নাক ফুল মনে করত। চোখ মুছতে মুছতে বের হয়েছিলাম।

আমি আসার পর জনকন্ঠে ‘সাধু সাবধান’ কলামটি বন্ধ হয়ে যায়। জোট সরকারের নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি–বিচ্যুতি তুলে ধরতে প্রতি সপ্তাহে একটি করে সাধু সাবধান লেখা হতো। যতদূর মনে পড়ে, প্রথমে এই কলামটি লিখতেন মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাসুদ কামাল। এরপর এটা লেখার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর।

ভেজা চোখে সম্পাদকের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর তোয়াব ভাইয়ের রুমে যাই। ওনাকে সালাম করে বিদায় নেই। তোয়াব ভাই শুধু একটি বা দুটি শব্দ বলেছিলেন, যা মনে নেই। সাংবাদিকতায় থাকাটা তোয়াব ভাইয়ের কারণে। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছু। এ জন্য তাঁকে সাংবাদিকতার শিক্ষাগুরু মানি। উনি অসুস্থ। কিছুদিন আগে বাসায় গিয়ে বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে। আমার শিক্ষাগুরু বিছানায় শুয়ে আছেন। এতোটাই দুর্বল যে, চলাফেরা করতে পারেন না। আল্লাহ ওনাকে হেফাজত করবেন।

জনকন্ঠ ছেড়ে বের হওয়ার পর সেই কষ্ট আজও আছে। ইস্কাটনে জনকন্ঠ ভবনের সামনে গেলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওই ভবন ঘিরে কত স্মৃতি। মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সহকর্মীদের সঙ্গে গজারি কাঠের লাঠি নিয়ে প্রস্তুত থেকেছি। হকারদের সঙ্গে টেক্বা দিয়ে আলাদাভাবে পত্রিকার বিতরণ ব্যবস্থা চালুর চেষ্টায় যোগ দিয়েছি। খুলনায় গিয়ে এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে নিউজ করে এগারো মাস পুলিশ পাহারায় থেকেছি। ১৯৯৯ সালে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা তখন খুলনা বিভাগে ১১ হাজার থেকে ৫৮ হাজারে উঠেছিল সন্ত্রাসীদের নিয়ে নিউজ করার কারণে। ২০০০ সালের আশেপাশে পত্রিকাটি মোট ছাপা হয়েছে, ২ লাখ ৬০ হাজার এবং এই প্রচারসংখ্যার ধারেকাছেও কেউ ছিল না। সম্পাদকের মৃত্যুর খবর শুনে এসব অতীত মনে পড়ছে খুব।

জনকণ্ঠের সবচেয়ে বড় ক্ষতি ছিল সাংবাদিক শামসুর রহমান কেবল ভাইকে হারানো, দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সন্ত্রাস নিয়ে সাড়া জাগানো রিপোর্টের কারণে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে উনি মারা যাওয়ার দিনে আমি খুলনা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, অফিসের অনুমতি ছাড়া ঢাকায় আসলাম কেন? সম্পাদকও কয়েকদিন মজা করলেন। বললেন, ঢাকায় তো তোমার মতো বিপ্লবী সাংবাদিকের জায়গা নেই। আমি বললাম, অন্যত্র চলে যাই তাহলে? এরপর উনি যা করলেন, তা মনে পড়ে আজও।

আমার চশমাটা চাইলেন। হাতে নিয়ে ডান্ডা দুটি এদিক–ওদিক করে কী যেন চেষ্টা করলেন। আবার আমার হাতে দিয়ে পরতে বললেন। পরলাম। এবার তিনি বললেন, তোমার কানের ওপরে দাগ পড়ে গেছে। এই চশমা পাল্টাও। বললাম, পাল্টাবো। জানতে চাইলেন, কবে? বললাম, বেতন পেয়ে। আবার বললেন, কবে বেতন পাবা? বললাম, তা জানি না। খুলনা ছেড়ে ঢাকা আসার পর আমার বেতন এক মাস বন্ধ। এরপর হিসাব বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে ডেকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে বললেন। ওটা হাতে দিয়ে বললেন, যাও আজই চশমা কিনে নাও। ওনার কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, অ্যাকাউন্টে বেতন চলে যাবে। কাজকর্ম পুরোদমে শুরু করে দাও।

আতিকউল্লাহ খান মাসুদের এমন অনেক গল্প বলে শেষ করা যাবে না। খুলনায় থাকতে মনে হলো একটি মোটরসাইকেল কিনি। কারণ সেখানে জনকন্ঠ অফিসে আমার বসবাস। পুলিশকে না জানিয়ে বা পাহারা ছাড়া বাইরে বের হওয়া নিষেধ ছিল। সাবেক আইজিপি এ ওয়াই বি ওয়াই সিদ্দিকী এবং খুলনার তখনকার পুলিশ কমিশনার আনোয়ারুল ইকবাল আমার জন্য এই ব্যবস্থা করেছিলেন। আনোয়ারুল ইকবাল জান্নাতবাসী হয়েছেন। এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী বেঁচে আছেন, আজও আমি ওনার স্নেহ পাই। যাই হোক, ভাবলাম একটি মোটরসাইকেল কিনলে হেলমেট পরে মাঝেমধ্যে বের হতে পারব। কিন্তু এতো টাকা ছিল না। আমার কাছে কিছু টাকা ছিল। আর জনকন্ঠ সম্পাদকের কাছে ৩০ হাজার টাকা ঋণ চেয়ে একটি আবেদন পাঠালাম। দিনকয়েক পর চিঠির জবাবে সম্পাদক জানালেন, ‘আপনার কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে জনকন্ঠ কর্তৃপক্ষ আপনাকে একটি মোটারসাইকেল কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ চিঠিতে পত্রিকার প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা নিয়ে খুলনা থেকে মোটরসাইকেল কিনতে বলা হয়। এও বলা হয় যে, এটি ঋণ নয়, সম্পাদকের উপহার।

২০০২ সালে হঠাৎ একদিন সম্পাদক বললেন, আচ্ছা তুমি তো বিয়ে করলে কিছুদিন আগে। আমার গিফট পেয়েছিলে? বললাম, না। তখন নিয়ম ছিল, কেউ বিয়ে করলে এবং তা সম্পাদককে জানালে ১০ হাজার টাকা উপহার। আর কেউ বিদেশে গেলে তিনি কমপক্ষে একশ ডলার উপহার দিতেন। আমি ওনার উপহার পাইনি শুনে হিসাব বিভাগকে বললেন, তখন দিলে ১০ হাজার টাকা দিতাম, ভুলে গেছি বলে ২০ হাজার টাকা দিয়ে দাও।

সেই আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলি। সহকর্মীদের হাহাকার যতবার শুনতাম ততবারই আফসোস হতো। ১৯৯৩ সাল থেকে একযুগ এই মানুষটিকে যেমন দেখেছি, তা এখনকার অনেকেই হয়তো জানেন না। কিন্তু ওই সময়ে যাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছি, তারা জনকণ্ঠের ঈর্ষণীয় সুদিন দেখেছি। খায়রুল আনোয়ার, রেজোয়ানুল হক, হাসান হাফিজ, মোস্তফা ফিরোজ, ফজলুল বারী, আমান উদ দৌলা, সৈয়দ আবদাল আহমদ, মাসুদ কামাল, মোয়াজ্জেম হোসেন, হাসনাইন খুরশেদ, ইয়াসীন কবির জয়, আশীষ-উর-রহমান, কামরুল হাসান, মাহমুদ হাফিজ, আহমেদ দীপু, ইলিয়াস খান, আলী আজগর স্বপন, এজাজ হোসেন, নাজনীন আখতার, অমিত তালুকদারসহ চলে আসা অনেকেই সুদিনের সাক্ষী। রিপোর্টিং ও ফটোগ্রাফি ছাড়া অন্যান্য বিভাগেও এতোসংখ্যক সহকর্মী ছিলেন যে, নাম লিখে শেষ করতে পারব না।

এমন একজন সম্পাদক কেন আড়ালে চলে গেলেন? যে জবাব খুঁজে পেতাম তাহলো, সাংবাদিকতার বাইরে যাওয়ার কারণে তিনি অবস্থানচ্যুত হন। অথচ সাহসী সম্পাদক হিসেবেই ওনাকে পেয়েছি। চাপ দিয়ে কেউ আমাদের নিউজ বন্ধ করতে পারত না। ওনার মেজাজ চড়া হলে চোখ লাল হয়ে যেত। জোট সরকারের সময় বিজ্ঞাপন বন্ধ করে শিক্ষা দেওয়ার অপচেষ্টা ছিল। এখনকার মতো বেসরকারি বিজ্ঞাপন ততটা ছিল না। তখন প্রায় অর্ধেক আয় আসত সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে। সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হলেও তিনি লড়াই করে গেছেন।

একটা সময় ওনার আশেপাশে কিছু পরামর্শদাতার অস্তিত্ব অনুভব করতাম, যাঁরা তাঁকে নানা ব্যবসা–বাণিজ্যের দিকে টেনে নিয়েছেন। প্রতিটি ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। এমনকি জনকন্ঠ পত্রিকা করার আগে ওনার যেসব ব্যবসা ছিল, সেগুলোও নষ্ট হয়েছে। পরে যেসব ব্যবসা করতে চেয়েছেন সেগুলোর একটিও দাঁড়ায়নি। ডেভেলপার হওয়ার চেষ্টা করেছেন। শেয়ার বাজারে গেছেন। লবনের কারখানা, গরুর খামার করারও চেষ্টা ছিল। এসব করতে গিয়ে তিনি লোকসানে পড়লেও তাঁর চারপাশের কিছু মানুষ অবশ্য আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন। এ নিয়ে নানা গুঞ্জন ও জনশ্রুতি আছে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পত্রিকাটির অবস্থান ছিল। শুধুই সাংবাদিকতা পত্রিকাটিকে গৌরবোজ্জল ভূমিকায় নিয়েছিল। সেই প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক–কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন, এর চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। সেই কষ্ট আরও বেড়ে গেল যখন প্রতিষ্ঠানটির কাণ্ডারি চলে গেলেন। সম্পাদক হিসেবে তিনি জীবনের শেষভাগে অনেকটাই ব্যর্থ, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁকে অস্বীকার করার উপায় নেই। স্যালুট বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »