অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই
পর্ব-৪
ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (৩১) শত্রুমুক্ত স্বাধীন দেশের তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে প্রথমবারের মতো গার্ড অফ অনার পরিদর্শনের পর বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে একটি খোলা ট্রাকে করে তিনি সরাসরি রমনা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে একাধিক সুদৃশ্য তোরণ, বাংলাদেশের পতাকা এবং তাঁর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দুপাশে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে দুই ঘণ্টা তের মিনিটে তিনি রমনা রেসকোর্সের বিশাল জনসভাস্থলে পৌঁছান। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল সাড়ে চারটা। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর মুখোমুখি থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু প্রথমে তাঁর পরিবার পরিজনের কাছে কিংবা বয়োবৃদ্ধ মাতা-পিতার কাছে যাননি। তিনি সবার আগে ছুটে গিয়েছেন তাঁর প্রিয় জনগণের কাছে। কারণ তিনি বাংলার মানুষদেরকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। সদা সর্বদা তিনি তাঁর দেশের জনগণ তথা দেশবাসীর কথাই চিন্তা করতেন। তাই সবার আগে সেই জনগণের কাছেই তিনি ছুটে গিয়েছেন। দেশের আপামর জনসাধারণের প্রতি একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতার হৃদয়ের টান কতটা তীব্র ও গভীর এবং প্রাণের আবেগ কতটা অকৃত্রিম হলে এমনটা হতে পারে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
(৩২) দীর্ঘ কারাবাসের অনিবার্য ক্লান্তিতে মলিন বঙ্গবন্ধুর মুখটি তখনো ছিল প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ে সমুজ্জ্বল এবং জ্যোতির্ময়। এহেন অবস্থায় অত্যন্ত ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো একাধিকবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বারবার চোখ মুছে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি প্রায় ৪০ মিনিট ভাষণ দেন। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন – “… আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে… ।” তিনি দৃঢ় কণ্ঠে আরও বলেন- “… আজ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না… ।” জনসভা শেষে বঙ্গবন্ধু বাড়িতে ফিরলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তাঁর বাড়িতে ফিরার সেই দৃশ্যের ব্যাপারে ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারি লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা বর্ণনা করে- “… বিশাল জনসভা শেষে ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে একটি গৃহে ঘটে বর্ণনাতীত এক আবেগপ্রবণ পুনর্মিলন। বন্ধুদের শুভেচ্ছা সূচক ফুলের পাঁপড়িতে শোভিত শেখ মুজিব তাঁর দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। ঘটনা এর চেয়েও এগিয়ে যায় যখন শেখ মুজিব তাঁর ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতার পা স্পর্শ করে ৮০ বছরের মা কে বুকে জড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন [সূত্রঃ ৩২ নম্বরের বাড়ি ও সুধা সদন- এম. নজরুল ইসলাম; সুবর্ণ প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ১৭ই মার্চ, ২০১৬ পৃষ্ঠা ৪৬]।”
(৩৩) দেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজন অবশ্যই জানেন ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অতর্কিতে ঘুমন্ত দেশবাসীর উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে মধ্যরাত শেষে তথা ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু নিজে স্বয়ং দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ হানাদার মুক্ত হয় এবং আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। কিন্তু ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন বিধায় আমাদের স্বাধীনতা পুরোপুরিভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে আমাদের এই স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গতা পায়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের পাশাপাশি দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সমমনা অন্যান্য দলগুলো ১০ই জানুয়ারি পালন করেনা। আর তা পালন না করার কোন কারণ কিংবা কোন ব্যাখ্যাও তারা কখনো দেশবাসীর নিকট উপস্থাপন করেননি। এর অন্তর্নিহিত কারণ সমূহ সন্দেহজনক এবং রহস্যাবৃত বলে বিবেচিত হয়।
(৩৪) একথা সর্বজনবিদিত যে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতা, সাহসিকতা এবং বিচক্ষণতার সাথে সরকার এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। এহেন যুদ্ধ পরিচালনার পূর্বে ১০ই এপ্রিল এই সরকার কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয়। যা আমাদের সংবিধানের ৭ম তফসিলে যথারীতি বিবৃত রয়েছে। পরে ১৭ই এপ্রিল সরকার গঠন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের ন্যায় বিএনপি এবং তাদের জোটভুক্ত সমমনা অন্যান্য দলগুলো সংবিধান স্বীকৃত উপরোক্ত ১০ই এপ্রিল কিংবা ১৭ই এপ্রিল এর কোনটাই স্বীকার করেনা এবং তা পালন ও করেনা। এটা দলগতভাবে তাদের সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা এবং ভেদবুদ্ধির বহিঃপ্রকাশ বলে জোরালোভাবেই বিবেচিত হয়। এরই পাশাপাশি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ঘটনাবলীর প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান কিংবা শ্রদ্ধা পোষণ না করা অথবা ইচ্ছাকৃতভাবেই অবজ্ঞা এবং অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সংবিধান লঙ্ঘনের সামিল বলে যে কোন প্রকার সন্দেহ ব্যতিরেকে প্রমাণিত হয়।
(৩৫) শত্রু মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসার পর ১৯৭২ সনের ১২ই জানুয়ারি একেবারে শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেন। এহেন অবস্থায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শত্রুদের নানামুখী ষড়যন্ত্র এবং অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম তাঁকে সদা সর্বদা ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। কিন্তু অবিনাশী চেতনার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় এবং শক্ত হাতে তা দমন করে সরকার পরিচালনা করতে থাকেন। এহেন অবস্থায় তিনি প্রতি পদে পদে হিমশিম খেতে থাকেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠনের সময়ে তথা বিগত ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে মোট ৩৩ টি মন্ত্রণালয় ছিল। এই ৩৩ টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ২৯ টি মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকারের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং অনুগত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও উচ্চ পদস্থ তথা উপযুক্ত কর্মকর্তার অভাবে আপাদমস্তক পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন ঐ সমস্ত কর্মকর্তাদেরকে দিয়েই তাঁকে সরকার পরিচালনা করতে হয়। উপরোক্ত কর্মকর্তাদের এহেন মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবগত এবং অবহিত থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনভাবেই পিছু হটেননি কিংবা প্রতিশোধ পরায়ণ হননি। বরং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সর্ব শক্তি নিয়ে আত্মনিয়োগ করে দীপ্ত পদে সম্মুখ পানে এগিয়ে গিয়েছেন।
(৩৬) অত্যন্ত পীড়াদায়ক হলেও সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ব্যর্থ এবং অকার্যকর করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কূট কৌশলে তাদের নানামুখী ষড়যন্ত্র এবং অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এহেন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা পাটের গুদামে আগুন, থানা লুট, পুলিশ ফাঁড়ি লুট সহ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার হিংসাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এরই পাশাপাশি তৎকালীন দৈনিক গণকণ্ঠ, সাপ্তাহিক হককথা এবং ইংরেজী সাপ্তাহিক হলিডে প্রভৃতি পত্রিকা সমূহ নিয়মিতভাবে এবং অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধরনের গুজব এবং সর্বৈব মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশের সহজ সরল জনগণকে নানাভাবে বিভ্রান্ত, প্ররোচিত এবং ক্ষেপিয়ে তোলার নিমিত্তে বিরামহীনভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি এবং বাংলা একাডেমী সহ পি, আই, বি এবং জাতীয় আর্কাইভে সংরক্ষিত পুরনো কাগজপত্র সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ খবর করলে উৎসাহী পাঠক এবং অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিবর্গ উপরোক্ত পত্রিকা সমূহের নির্ভেজাল মিথ্যাচার এবং বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হতে পারবেন।
(৩৭) দেশবাসী নিশ্চয়ই জানেন দেশী-বিদেশী কুচক্রীমহলের অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার সহ নানামুখী অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম সমূহ সামাল দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়। এরই পাশাপাশি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকারকে মোকাবেলা করতে হয় অত্যন্ত ভয়াবহ এবং দুরতিক্রম্য একটি মারাত্মক সমস্যা। আর তা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হস্তগত হওয়া বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্রসমূহ সরকারের নিকট সমর্পণে অনিচ্ছুক বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত পরিকল্পিত গুপ্তহত্যা। অস্ত্রধারী এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেউবা ছিলেন স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধিতাকারী পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, কেউবা তৎকালীন চীনপন্থী অথবা চারু মজুমদার পন্থী নকশাল, কেউবা মাওবাদী হক-তোয়াহা-আলাউদ্দিন-মতিন এবং সিরাজ শিকদার – প্রমুখদের অনুসারী সর্বহারা গ্রুপের সদস্য। আবার কেউবা স্বদেশপ্রেমিক অথচ সমাজ বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা। কেউবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ডাকাত।
(৩৮) এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এবং সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি দেশকে পুনর্গঠনের পরিবর্তে এই সমস্ত অস্ত্রধারীদেরকে তাদের চাহিদা কিংবা প্রত্যাশা অনুযায়ী পুনর্বাসন কিংবা তাদের সবাইকে রাজনৈতিকভাবে সুযোগ সুবিধা প্রদান করে তুষ্ট রাখা সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী নতুন সরকারের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা। আবার এদের সবাইকে শক্ত হাতে দমন করাও একেবারেই অসম্ভব ছিল। স্বীকৃত মতেই ঐ সময়ে পুলিশ বাহিনী ছিল অনেকটা অগোছালো। সেনা বাহিনী ছিল দুর্বল, সিভিল প্রশাসনের একটি বড় অংশ ছিল পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন সুযোগ সন্ধানী এবং সুবিধাবাদী আমলা। এছাড়া চীন, মার্কিন ও সৌদি আরবের তৎকালীন সরকার ছিল অত্যন্ত বৈরী এবং প্রচণ্ড বিরূপ। উপরন্তু অব্যাহত ছিল শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণকারী এজেন্টদের নানামুখী ষড়যন্ত্র এবং ধারাবাহিক অপপ্রচার।
(৩৯) বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাকারী কট্টর সমালোচকগণ ও স্বীকার করেন যে, ব্যক্তি জীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রচণ্ড নরম এবং সংবেদনশীল মনের বেশ দয়ালু এবং অত্যন্ত হৃদয়বান মানুষ। সতীর্থ এবং সমকক্ষ নেতাকর্মী দের প্রতি তিনি ছিলেন অনেকটা উদার, সহানভূতিশীল এবং নিবেদিত প্রাণ। নির্দয়, নির্মম কিংবা কড়া হাতে শাসনের মাধ্যমে কাউকে দমন করা তাঁর স্বভাবে ছিল না। তাই তিনি কোনভাবেই কঠোর হতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন তাঁর শত্রু মিত্র সবাই। তিনি নিজে অত্যন্ত উদার, মহৎ এবং বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন বিধায় উদার নৈতিক মন মানসিকতা দিয়েই তিনি সবাইকে বিচার করতেন। উপরন্তু তিনি নিজে সৎ এবং পরিচ্ছন্ন ছিলেন বিধায় পূর্বাপর বিচার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে সবাইকে বিশ্বাস করতেন এবং আপন করে নিতে চাইতেন। তাঁর এহেন মহান চারিত্রিক গুণাবলীর সুযোগ নিয়ে অনেকেই তাঁর কাছে এসেছেন। পরে আবার সুযোগ বুঝে যথেষ্ট ক্ষতি ও করেছেন। শেষ পর্যন্ত নিজের বুকের তরতাজা রক্ত সহ সপরিবারে শাহাদাৎ বরণের মাধ্যমে তাঁকে তাঁর এহেন সীমাহীন উদারতা এবং অপরিসীম মহত্বের মূল্য দিতে হয়েছে।
(৪০) দেশবাসী অবগত রয়েছেন যে ১৯৭২ সনের ১২ই জানুয়ারি সরকার গঠনের পর মাত্র ১০ মাস সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই সংবিধান অনুমোদনের জন্য ১৯৭২ সনের ৪ঠা নভেম্বর জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। দেশ পরিচালনার জন্য চারটি মূল নীতি তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদকে এই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। এরই পাশাপাশি দেশবাসীর সকল প্রকার মৌলিক এবং মানবাধিকার সর্বান্তকরণে সংরক্ষণের নিমিত্তে নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। তাই এই সংবিধান যে কোন বিবেচনায়ই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি সংবিধান হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হয়। বিগত ১৯৭২ সনের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে এই সংবিধান আমাদের দেশে কার্যকর হয়েছে। সশস্ত্রভাবে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের পর তথা বিপুল আত্মত্যাগ এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর এত কম সময়ে দেশ ও জাতিকে এরকম যুগোপযোগী একটি সংবিধান উপহার দেয়ার কোন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।
ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ), লেখক ও কলামিস্ট