অভিশপ্ত ১৫ই আগস্ট

অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট  নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই

পর্ব- ২

ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (১১) দেশপ্রেমিক ব্যক্তি মাত্রই জানেন বঙ্গবন্ধু যেমন রাজনীতি শাস্ত্রের সুনিপুণ কারিগর এবং দূরদর্শী ছিলেন ঠিক তেমনই ছিলেন অত্যন্ত প্রাজ্ঞ, নির্ভুল এবং বিচক্ষণ এক রাজনীতি বিশারদ। তাই দুরাচারী পাকিস্তানী শাসকদের মনোভাব তিনি পূর্ব থেকেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু যদি দেশের কোথাও পালিয়ে যেতেন অথবা পালিয়ে ভারতে কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্রে চলে যেতেন, তাহলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে বহিঃর্বিশ্বে প্রচার করতেন এবং এই মর্মে তাঁকে সারা জীবন ধরে দোষারোপ করতেন। কিন্তু বিদগ্ধ এবং পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুকে এই অপবাদ দেয়ার সুযোগটি তিনি পাকিস্তানীদের হাতে দেননি। একজন নেতা কতটা তুখোড়, অকুতোভয় এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে তাঁর প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুদের মনোভাব এবং পরিকল্পনা নির্ভুলভাবে বুঝতে পারেন তা বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রখর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দ্বারা প্রমাণ করেছেন। তাই তাঁকে গ্রেফতারের পূর্বেই রেকর্ড করা স্বাধীনতার ঘোষণা ২৫শে মার্চের মধ্যরাত শেষে তথা ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে রাত ০১-০১ মিনিটের সময়ে তৎকালীন EPR (East Pakistan Rifle) -এর ওয়্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মুজিব নিজে স্বয়ং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমাদের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে উক্ত ঘোষণাটি যথারীতি বিবৃত এবং বিধৃত রয়েছে। এ নিয়ে যে কোন ধরনের বিতর্ক নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত [ সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র ৩য় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পৃষ্ঠা- ১]।

(১২) বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত উপরোল্লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান সামরিক কর্মকর্তা লেঃ জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান (এ এ খান) নিয়াজীর জন সংযোগ কর্মকর্তা তৎকালীন মেজর সিদ্দিক সালিক তার Witness to Surrender বইয়ে অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে বিবৃত করেছেন-

“When first shot has been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through a wave length close to that of official Pakistan Radio. In what must have been and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh. [Witness to Surrender, Oxford University Press, Karachi, 1977, Page- 75]।”

(১৩) বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অত্যাসন্ন ছিল বলে জানা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাননি। ফলে ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই বর্বর সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে প্রথমে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। পরে বন্দী অবস্থায় তাঁকে উক্ত ক্যান্টনমেন্ট থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর এহেন স্বেচ্ছা বন্দিত্বকে তাঁর কট্টর সমালোচকদের পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধী মহল আত্মসমর্পণ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। যারা তা করেন তারা কিছুতেই বুঝতে কিংবা মানতে চাননা যে, আত্মসমর্পণ (surrender) এবং স্বেচ্ছা বন্দিত্ব (wilful imprisonment) কোনভাবেই কোন সমার্থক শব্দ নয়। উপরোক্ত দুটি শব্দই অর্থ, গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং ভাষাগত দিক দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ। আত্মসমর্পণের অর্থ হলো নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন কিংবা বিকিয়ে দিয়ে বিজয়ীর নিকট অথবা কোন আদালত কিংবা কোন কর্তৃপক্ষের নিকট নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেয়া। পক্ষান্তরে স্বেচ্ছা বন্দিত্ব হলো কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে কোন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একটি পরিকল্পিত এবং চূড়ান্ত প্রক্রিয়া ও বিজ্ঞ জনোচিত কৌশল।

(১৪) মহান মুজিব এবং বাঙালির ইতিহাস সম্পর্কে যারা খোঁজ খবর রাখেন, তারা একথা অবশ্যই জানেন যে, বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বিগত ১৯৬৮ সনের ৩রা জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দাখিল করেন। ঐ মামলার প্রেক্ষিতে ১ নং আসামী শেখ মুজিবকে ঐ বছরের ১৮ই জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। ঐ মামলায় মোট আসামী ছিলেন ৩৫ জন। অত্যন্ত ব্যাপক ভিত্তিক তুমুল গণ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বিগত ১৯৬৯ সনের ২২শে ফেব্রুয়ারি উপরোক্ত মামলা প্রত্যাহার করে নিতে এবং শেখ মুজিব সহ অন্যান্য আসামীদেরকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। পরের দিন ২৩শে ফাব্রুয়ারি তৎকালীন রমনা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানের বিশাল গণ অভ্যর্থনায় সুবিশাল ছাত্র জনসভার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আর এমনি করেই নিভৃত পল্লী টুঙ্গিপাড়ার ভূমিপুত্র তথা মায়ের প্রাণের ধন, বাবার চোখের মণি এবং সবার আদরের খোকা প্রথমে হয়েছেন শেখ সাহেব আর ঐ দিন থেকে হলেন বঙ্গবন্ধু। পরে নদী-নালা-খাল-বিল পেরিয়ে নানা প্রতিকূলতার মাঝে ঝড়-ঝঞ্চা অতিক্রম করে এবং শেষ পর্যন্ত রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে হয়ে গেলেন মহান বাঙালি জাতির পিতা।

(১৫) অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, ভয়-ভীতি কিংবা প্রলোভন অথবা অন্য যে কোন কারণেই হউক না কেন, ঐ মামলার কয়েকজন আসামী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। তাই আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু পূর্বাপর অত্যন্ত সাবধান এবং সতর্ক ছিলেন। একই কারণে এতদ সংক্রান্ত সামগ্রিক ব্যাপারে তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং কর্মপদ্ধতি সমূহ তিনি কঠোর গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ধাপে ধাপে এবং পর্যায়ক্রমে প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের পাশাপাশি তাঁর প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত করার নিমিত্তে তিনি খুবই সচেতনভাবে এবং অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এরই পাশাপাশি গোটা জাতিকে সুশৃঙ্খল এবং ঐক্যবদ্ধভাবে মরণপণ যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার জন্য তিনি চূড়ান্তভাবে ছক প্রস্তুত করেছেন এবং তৎপ্রেক্ষিতে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন। তাঁর এহেন ছক এবং পরিকল্পনার আলোকে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শত্রুমুক্ত হয়েছে আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বদেশভূমি।

(১৬) পাকিস্তানী শাসকবর্গ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করবে বলে তিনি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত ছিলেন। তাই তাঁর অবর্তমানে তাঁর ঘনিষ্ঠ সব নেতাকর্মীরা কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন এবং কি কি ভাবে যাবেন – কে কে কি কি দায়িত্ব পালন করবেন সেসব ব্যাপারে সবাইকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে তিনি নিজে অপেক্ষায় ছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য। পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী এবং অবিমৃষ্যকারী শাসকবর্গের হঠকারী সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের মাধ্যমে অবশেষে সেই সুযোগটি ও বঙ্গবন্ধুর হাতে এসে যায়। সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনার ঊর্ধে উঠে পরিচ্ছন্ন মন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই সমস্ত পরিকল্পনা এবং কর্মপদ্ধতির ইতিহাস গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হলে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতার ব্যাপারে তাঁর কঠোর সমালোচনাকারীগণ ও সন্দেহমুক্ত হতে পারবেন।

(১৭) সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন- “… তিব্বতের দালাইলামা ১৯৫৯ সালে স্বাধীনতার জন্য পঞ্চাশ হাজার তিব্বতী ভিক্ষু ও যোদ্ধা নিয়ে ভারতে চলে গিয়েছেন। ভারত তাদের আশ্রয় দিলেও স্বাধীনতার জন্য কিন্তু সেভাবে সাহায্য করেনি। ফলে তিব্বত আজও স্বাধীন হতে পারেনি। প্যালেস্টাইন ৭০ বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে চলেছে। আরব দেশগুলো প্যালেস্টাইনের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদেরকে বলেছে সব রকম সাহায্য করবে। কিন্তু প্যালেস্টাইন এখনো স্বাধীন হয়নি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। নিঃসন্দেহে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় শৌর্য, বীর্য এবং জনগণের অপরিসীম ত্যাগ এই স্বাধীনতার প্রধান প্রণোদনা। কিন্তু ভারতের সহযোগিতা ছাড়া এই স্বাধীনতা আমরা কতদিনে অর্জন করতে পারতাম, সেটা বলা কঠিন। আর ভারতের এই নজিরবিহীন সহযোগিতা নিশ্চিত করেছেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর আরেকটি দূরদর্শিতার প্রমাণ হচ্ছে, ২৫শে মার্চ কেন তিনি ভারতে গেলেন না? তিনি যখন ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আমি চলে গেলে পাকিস্তানীরা আমাকে খোঁজার জন্য এখানে ঘরে ঘরে গণহত্যা চালাত’ ― এটা আংশিক সত্য। পাকিস্তানীরা অবশ্যই ঢাকা শহর ম্যাসাকার করে দিত। কিন্তু আরেকটি সত্য হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু দালাইলামার কথা জানতেন। তিনি যদি ভারতে চলে যেতেন এবং ভারত যদি বাংলাদেশকে সাহায্য না করত, তাহলে তাঁর অবস্থাও দালাইলামার মতো হতো। এই কথাটা আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আমাকে বলেছেন। তারা যখন বঙ্গবন্ধুকে একাধিকবার ভারতে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘তোরা আমারে দালাইলামা বানাইস না’ [দ্রঃ বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির এক দশক- শাহরিয়ার কবির, জনকণ্ঠ, ১৮-০৮-২০২০]।”

(১৮) শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ অবশ্যই স্বীকার করবেন- “একজন দক্ষ সেনাপতি বা একজন জেনারেলকে যুদ্ধে জয়ের জন্য অনেক পথ খোলা রাখতে হয়। বিকল্প ও রাখতে হয়। যিনি যতগুলি বিকল্প পথ বের করতে পারবেন, তত সহজে তিনি যুদ্ধ জয় করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়েছিলেন – পাকিস্তানী আর্মির কাছে ধরা দিয়ে। কারণ ২৬শে মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তানী আর্মি তাঁকে গ্রেফতার না করে তৎক্ষণাৎ হত্যা ও করতে পারত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কিন্তু প্রথম তিনদিন বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গে আছেন। যেটা নিয়ে মিসেস গান্ধীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ‘এগুলো কী প্রচার করছে তারা? বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানীরা গ্রেফতার করে ফেলেছে। ওরা বলছে আমাদের সঙ্গে আছেন। পাকিস্তানীরা তো তাঁকে মেরে ফেলে বলবে উনি ভারতে চলে গেছেন।’

বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি। তাঁর দল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়ী হয়েছে। কোন কারণে ভারত যদি প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে এবং পাকিস্তানীরা তাঁকে যদি হত্যা না করে তাহলে তাঁর সঙ্গে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোদের অবশ্যই কথা বলতে হবে। এটা ছিল একটা বিকল্প অপশন। সে জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি ধরা দিয়েছেন। জেলের ভিতর কবর খোঁড়ার কথা তিনি বলেছেন। সেখানেও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতের একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে। যখনই ঘোষণা করা হলো তাঁর বিচার করা হবে এবং বিচারে তাঁকে ফাঁসি দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, তখন ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর মন্ত্রীরা বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা করার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরেছেন [দ্রঃ বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির এক দশক- শাহরিয়ার কবির, জনকণ্ঠ, ১৮-০৮-২০২০]।

(১৯) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁদের নিজ নিজ দেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে গিয়ে তাঁরা কেউই কখনো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। বরং দুজনেই অসংখ্যবার স্বেচ্ছা বন্দিত্ব বরণ করেছেন। মহাত্মা গান্ধী এবং নেলসন ম্যান্ডেলার এহেন স্বেচ্ছা বন্দিত্ব তথা স্বেচ্ছা কারাবরণ (Voluntary Imprisonment) নিয়ে তাঁদের ঘোরতর শত্রুরাও কখনো কোন প্রশ্ন তুলেননি কিংবা কটাক্ষ করেননি অথবা কোন সমালোচনাও করেননি। সুতরাং পূর্বাপর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিন্তাভাবনা করেই আমাদের অনুপ্রেরণার অনন্ত উৎস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিব গান্ধীজী এবং নেলসন ম্যান্ডেলার উপরোক্ত সুমহান দৃষ্টান্ত এবং কৌশল অনুসরণ করেছেন মাত্র। তাঁর এহেন সুদূরপ্রসারী কৌশল তাঁর অনন্য সাধারণ প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক বটে। তাই এতদসংক্রান্ত ব্যাপারে জ্ঞানপাপীদের পরিকল্পিত মিথ্যাচার এবং কপটচারিতা নিদারুণভাবে অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং দুরভিসন্ধিমূলক বলে জোরালোভাবেই বিবেচিত হয়।

(২০) দেশ ও জাতির কল্যাণে সারা বিশ্বের ত্যাগী, সংগ্রামী এবং নিবেদিত প্রাণ নেতাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে রাশিয়ার মহামতি লেনিন, গণ চীনের মাও সে তুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো এবং বলিভিয়ার চে গুয়েভারা- প্রমুখদের নাম পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। এই সব প্রাতঃস্মরণীয় নেতাদের সবাই অবর্ণনীয়, অকল্পনীয় এবং অতুলনীয় ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং দেশপ্রেমের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে রণনীতি, রণকৌশল এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনার গৌরব ও কৃতিত্বের দিক দিয়ে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উপরোক্ত প্রাতঃস্মরণীয় নেতাদের চেয়ে ও অনেক বড় মাপের নেতা বটেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের প্রহসনমূলক গোপন বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও বঙ্গবন্ধু দেশমাতৃকার স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোষ করেননি। সামরিক স্বৈরশাসকদের কাছে এক মুহূর্তের জন্যও মাথা নত করেননি। তাই মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়েও নীতি, আদর্শ এবং নৈতিকতা পুরোপুরিভাবে বজায় রাখার পাশাপাশি নিজের অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে পর্বতের ন্যায় অটল, অনড় এবং অবিচল থাকায় উপরোক্ত সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দের সাথে বঙ্গবন্ধুর পার্থক্য সত্যি প্রশংসন ।

ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ),লেখক ও কলামিস্ট 

(চলমান)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »