অভিশপ্ত ১৫ ই আগস্ট নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই
পর্ব-১
ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (১) মানব সভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত বেদনা বিধুর এবং কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ংকর দিন ১৫ই আগস্ট। এই দিনটি সমস্ত বাঙালি জাতির জন্য পরম বেদনায় সিক্ত এবং গভীরতম দুঃখ ভারাক্রান্ত একটি দিন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস এবং বর্বরতম ঘটনার স্মৃতিবহ ঘটনার সাক্ষী ১৫ই আগস্ট। ১৯৭৫ সনের এই কলংকময় দিনে বাঙ্গালি জাতি হারায় তাদের হাজার বছরের আরাধ্য ইতিহাসের মহানায়ক এবং বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্য সহ অন্যান্যদেরকে। তাই বাঙালির জীবনে সবচেয়ে শোকাবহ এবং অভিশপ্ত মাস আগস্ট।
(২) সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন দেশী এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নরপিশাচ ঘাতকদের অত্যন্ত বেপরোয়া এবং বিবেক বর্জিত একটি দল এই দিন শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। এদিন তারা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় মেতে উঠেছিল অদম্য রক্ত পিপাসায়। তাই তারা একে একে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, তাঁদের তিন পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল সহ দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। ঘাতকেরা একে একে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর অনুজ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবত, তার পুত্র আরিফ, মেয়ে বেবী এবং শিশু পৌত্র সুকান্তকে। পাষণ্ড ঘাতকেরা এই দিন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি সহ তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে।
(৩) একাত্তরের পরাজিত শক্তির অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং সর্বনাশা চক্রান্তের শিকার হয়ে নিতান্তই অপরিণামদর্শী একদল নরপশুদের অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল এবং বিচারবুদ্ধিহীন পৈশাচিকতায় নির্মমভাবে বলি হয়েছেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার পরিজন। এই দিনে ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পাশাপাশি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় আরও হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল সহ আরও কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদেরকে। এমনকি রাজনীতির সাথে সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা কিংবা সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও নারী এবং শিশুরাও রক্ষা পায়নি ঘৃণ্য কাপুরুষ এই নরাধম ঘাতকদের উন্মত্ত রোষানল থেকে। শুধুমাত্র বিদেশে তথা পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থান করার কারণে এদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। তাই আজকের এই দিনটি বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত এবং কলঙ্কিত দিন। আর ঠিক একারণেই অভিশপ্ত ১৫ই আগস্ট প্রতিটি বাঙালির কাছে চরম শোকের দিন এবং বুক চাপড়িয়ে কান্না করার দিন। তাই অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই আজ জাতীয় শোক দিবস।
(৪) একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, চিরকাল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আসা বাঙালি জাতির নিকট পাকিস্তানের মহা পরাজয় ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং একটি ভূ-খণ্ডকে হারানোর বেদনা তারা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদেরই প্রেতাত্মা কতিপয় বিশ্বাসঘাতক পাষণ্ড খুনী এবং তাদের সহযোগী সহ নিজ দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যম শ্রেণীর কয়েকজন বিপথগামী অফিসার হায়েনার মতো ছুটে এসে অত্যন্ত নির্দয় এবং নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। একথা সবাই জানেন যে কারবালা প্রান্তরে পাপিষ্ঠ এজিদের দুর্বিনীত সৈন্যদের হাত থেকে হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) -এর পরিবারের নারী ও শিশুরা রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ই আগস্টের রক্ত পিপাসু সৈন্যদের নির্মমতা এবং বর্বরতা থেকে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর আত্মীয়ের পরিবারের কোন নারী কিংবা কোন শিশু এমনকি অন্তঃসত্ত্বা আরজু মনি ও রেহাই পাননি। তাই ঐ দিনের ঘাতক হায়েনারা তাদের প্রভুদের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে কতটা নির্দয়, নিষ্ঠুর এবং জিঘাংসা মূলক মনোবৃত্তিতে আচ্ছন্ন, প্রচ্ছন্ন এবং নিমজ্জিত ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।
(৫) আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করেন তারা অবশ্যই জানেন ১৯৫২ এবং ১৯৬৬ এর রক্ত রঞ্জিত পথ পেরিয়ে ১৯৬৯ -এ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণ অভ্যুত্থান হয়। এই গণ অভ্যুত্থানে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতাচ্যুত হন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পরবর্তীকালে তার অধীনেই বিগত ১৯৭০ সনে সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে অখণ্ড পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। তাই অত্যন্ত ন্যায় সঙ্গত এবং আইন সঙ্গত কারণেই সারা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে হকদার ও অধিকারী ছিলেন।
(৬) অপ্রিয় হলেও সত্য যে মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ- ভাসানী) ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ঐ সময়ে তারা “ভোটের আগে ভাত চাই” দাবি তুলে নির্বাচন বর্জন করেন। মাওলানা ভাসানীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল ও যদি ঐ নির্বাচন বর্জন করতেন তথা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতেন- তাহলে তাঁর একক নেতৃত্ব কোনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতো না এবং আওয়ামী লীগ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নিজেকে দাবি করার আইনানুগ কোন সুযোগই পেত না। আর তা না হলে বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক কিংবা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অথবা বিরোধিতাকারীগণ বাঙালির একক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তাঁকে কোনভাবেই মেনে নিতেন না। এহেন অবস্থায় আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এককভাবে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব হতো না। ফলে বাংলাদেশ এত তাড়াতাড়ি স্বাধীন ও হতো না।
(৭) এই নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ায় এবং একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামীলীগ আত্ম প্রকাশ করায় সম্পূর্ণ আইন সঙ্গত এবং ন্যায় সঙ্গত কারণেই আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তা করেননি। উপরন্তু ১৯৭১ -এর ১লা মার্চ বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এহেন অবস্থায় ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়ে পুরো বাঙালি জাতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু অসীম সাহস, পরম ধৈর্য এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে প্রতিবাদ মুখর বাঙালি জাতিকে শান্ত এবং সুশৃঙ্খল রেখে সুনিপুণভাবে নেতৃত্ব দিতে থাকেন।
(৮) দেশবাসী জানেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এহেন বেআইনী এবং অপরিণামদর্শী ঘোষণার প্রতিবাদে মুক্তি পাগল বাঙালি জাতি অত্যন্ত সোচ্চার এবং প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মার্চের প্রথম থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তথা সারা বাংলায় চলতে থাকে হরতাল এবং অবরোধ সহ অসহযোগ আন্দোলন। এহেন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল এবং অবরোধের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলন চলমান থাকাবস্থায় এসে গেল বহুল আকাঙ্ক্ষিত ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ। বাঙালির স্বাধিকার, স্বাধীনতা এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭১ -এর ৭ই মার্চ একটি অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল এবং ঐতিহাসিক দিন। এই দিন বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রমনা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তি পাগল ১০ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে অত্যন্ত বলিষ্ঠ, তেজোদ্দীপ্ত এবং দিক নির্দেশনা মূলক এক ভাষণ দেন। যা গুরুত্ব, মাহাত্ম, মর্যাদা এবং তাৎপর্যের দিক দিয়ে সারা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
(৯) বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত অলিখিত এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণের মাধ্যমে অধিকার হারা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শোষণ, বঞ্চনা এবং নিপীড়নের সুদীর্ঘ ইতিহাস অত্যন্ত প্রাঞ্জল, ছন্দময় এবং কাব্যিক বাক্যচয়নের মাধ্যমে কখনো আবেগ, কখনো যুক্তি, কখনো প্রশ্ন আবার কখনোবা অত্যন্ত জোরালো এবং সুচিন্তিত দিক নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পাগল দেশবাসীর পাশাপাশি বিশ্ববাসীর কাছেও সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন। তাঁর এহেন গোছালো, প্রাণবন্ত এবং আবেগঘন ভাষণের মাধ্যমে সুদীর্ঘ দিন ধরে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত এবং অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতি পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকার এবং তাদের বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যাসন্ন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নিমিত্তে দুর্দমনীয় সাহস এবং অফুরন্ত অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে। তাই এহেন তেজোদীপ্ত এবং প্রেরণাদায়ক ভাষণটি যে কোন বিবেচনায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য এক অনির্বাণ আলোকবর্তিকা তথা ম্যাগনা কার্টা বটে।
(১০) দেশবাসী নিশ্চয়ই জানেন বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত কালজয়ী, হৃদয়গ্রাহী এবং প্রাণবন্ত ভাষণের পূর্ব থেকেই সারা বাংলাদেশে চলছিল অত্যন্ত প্রবল এবং অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন। এহেন অবস্থায় ৭ই মার্চের ভাষণের পর উক্ত আন্দোলন আরও বেগবান এবং তীব্র আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় দুর্দমনীয় এবং অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের তীব্রতায় দুর্বিনীত পাকিস্তান সরকার পুরোপুরিভাবে বেসামাল হয়ে পড়ে। ফলে সরকার বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। বেশ কয়েকদিন ধরে আলোচনা চললেও পরে তা ব্যর্থ হয়। এহেন অবস্থায় সেনাবাহিনীকে সামরিক অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। এহেন নির্দেশের পর তাদের বর্বর সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে সর্বশক্তি নিয়ে ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরই পাশাপাশি রাত ০১-২০ মিনিটে তারা বঙ্গবন্ধুকে তার ৩২ নং ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ।
ড. মোঃ ফজলুর রহমান, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ)