উপ সম্পাদকীয়
কবির আহমেদঃ ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ ভাষা দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাংলাদেশের মানুষ নিজের মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাই এই দিবসটিকে স্মরণ করে রাখার জন্য বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী মানুষ বিশেষভাবে স্মরণ করে থাকেন। এই দিনটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। বাঙ্গালী জনগণের এই ভাষার জন্য আন্দোলনের এক মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত দিন হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারী চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, শফিক, সালাম, বরকত,জব্বার, সহ আরও অনেকে। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বৎসর ২১শে (একুশে) ফেব্রুয়ারী বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণ দাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশে সমগ্র পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা উর্দু করার ঘোষণা দিলে তৎক্ষণাৎ শিক্ষার্থীরা প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারপর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও, বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; অন্যদিকে,এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। আবার পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব পাকিস্তান(পূর্ব বাংলা) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকারের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একই ভাষা অর্থাৎ রাস্ট্র ভাষা উর্দু ঘোষণা করলে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সঞ্চার ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও এই অন্যায্য সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন পুরানো ঢাকার বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক । সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বার সহ আরও অনেকে। এছাড়াও সেদিন আরও ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, কয়েকদিন পর আহতদের থেকে আরও কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেন। কিন্ত তাদের নাম আর কেহ লিপিবদ্ধ করেন নি। সেদিন শহীদদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
২১শে ফেব্রুয়ারীর ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় (বর্তমান গুলিস্তান) ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন ২১ শে ফেব্রুয়ারী পুলিশের গুলিতে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।
২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা “দৈনিক আজাদ”এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতী স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা হিসেবে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই দিনটি রাতের প্রথম প্রহরে দেশের রাস্ট্রপতি ও সরকার প্রধান ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মৃতির রক্ষার্থে নির্মিত শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক প্রদানের মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয়। তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক,সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন সহ সর্ব স্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের কবর জিয়ারত করে রুহের মাগফিরাতও কামনা করা হয়ে থাকে। ২১ শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশে সরকারী ছুটির দিন।
কবির আহমেদ /ইবি টাইমস