মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই
পর্ব-৬
ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (৪৭)এমতাবস্থায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান উপরোক্ত ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান রেডিওতে ভাষণ দেন। তার উপরোক্ত ভাষণে তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে দোষী সাব্যস্ত করেন। ইয়াহিয়া খান তাঁর ভাষণে বলেন –
“… Mujib is a traitor to the nation. This time he will not go unpunished…” [দ্রঃ বঙ্গবন্ধু: ইতিহাসের মহানায়ক, সূত্রঃ বাংলার কথা- বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, মুক্তধারা প্রকাশনী, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা- ১০]।
(৪৮)উপরোল্লিখিত একই ভাষণে তিনি আরও বলেন- “…It is quite evident that, the intention of Sheikh Mujib and his advisors was not to come to an understanding on the basis of one Pakistan. But was somehow to exert from me a proclamation which would in fact give birth to a confederation rather than a federation and by this plan they expected to establish a separate state of Bangladesh…” [দ্রঃ জিয়ার দলিলে জোটের ছুরি, সরদার সিরাজুল ইসলাম, জনকণ্ঠ, ১৩ই জুলাই, ২০০৪]।
(৪৯)পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের উপরোক্ত বক্তব্য সমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে খোলা চোখেই পরিলক্ষিত হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর ভাষণের কোথাও তিনি মেজর জিয়ার কোন নামই উল্লেখ করেননি। তাছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অপরাধে ইয়াহিয়ার উপরোক্ত ভাষণের পর পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বিচার করে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু মুজিবকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, মেজর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কোথাও কোন প্রকার অভিযোগই উত্থাপন করেননি। তাই জিয়াউর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার আদৌ কোন প্রশ্নই আসেনা। এরই পাশাপাশি অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অংশগ্রহণ এবং তাঁর কার্যক্রম সন্দেহজনক এবং বিতর্কিত মূলক বলে বিবেচিত হওয়ায় উক্ত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী মেজর জিয়াকে দু’বার সাসপেন্ড করেছিলেন বটে। [দ্রঃ বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার সংবিধান ও খালেদা জিয়ার দলিল, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জনকণ্ঠ, ২৫শে জুলাই, ২০০৪]।
(৫০)বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত উপরোক্ত স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে United News of India (U.N.I) ২৬শে মার্চ রাত ৮-২১ মিনিটে শিলং থেকে প্রথম খবর পাঠায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান আজ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘোষণা করেছেন। ঐ দিনের ইংরেজী খবর ছিল- “Sheikh Mujibur Rahman speaking over Swadhin Bangla (Free Bengal) betar kendra today proclaimed the birth of an independent Bangladesh.” এমতাবস্থায় ২৭শে মার্চ তারিখে ভারতের সকল শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রথম পাতার খবর ছিল- “শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।” ঐ সময়ে যে সমস্ত সাংবাদিক বিভিন্ন দৈনিক এবং সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন, তাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও উপরোক্ত ঘোষণার ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত হওয়ার মতো যথেষ্ট সুযোগ এবং অবকাশ রয়েছে বটে।
(৫১)উপরোল্লিখিত সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাও এহেন স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। ২৬শে মার্চ রাত ৯-০৭ মিনিটে আগরতলা থেকে “P.T.I; N.D.P; T.S.A and B.B.C একই সঙ্গে খবর পাঠায় “Broadcasting tonight from a clandestine radio station identified as “Voice of Independent Bangladesh”, the announcer said, “The Sheikh has declared the 75 million people of East Pakistan as the citizen of the sovereign independent Bangladesh”. উপরোক্ত সংবাদের পর ইউ,এন,আই প্রতি মিনিটে মিনিটে প্রচার করেছে- “Mujibur Rahman declared Bangladesh independent” [দ্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধর্ষণকারীদের ক্ষমা নেই, শাহরিয়ার কবির, জনকণ্ঠ, ১১ জুলাই, ২০০৪]।
(৫২)গণ মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উপরোল্লিখিত ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “Defence Intelligence Authority” -কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে তা যথাসময়ে যথারীতি জানানোও হয়। এহেন অবস্থায় পুরো মার্চ এবং এপ্রিল মাস জুড়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় “The Times; Financial Times; Newsweek” এবং ইংল্যান্ডের Telegraph & London Observer সহ বিশ্বের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা সমূহে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ যথারীতি ছাপাও হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঐসব পত্রিকা সমূহে এই নিয়ে একাধিকবার সম্পাদকীয় এবং উপ সম্পাদকীয়ও লেখা হয় বটে। উপরোল্লিখিত কোন একটি পত্রিকায়ই কখনো ছাপা হয়নি যে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আগ্রহী যে কেউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ডের উপরোক্ত পত্রিকা সমূহ অনুসন্ধান করে তাদের সন্দেহের অবসান ঘটাতে পারেন।
(৫৩)বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধান লেঃ জেনারেল এ,এস,এম নাসিম তাঁর রচিত “Bangladesh fights for independence” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- “On March 1971 Major Ziaur Rahman declared the independence of Bangladesh on behalf of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman from Swadhin Bangla betar kendra of Kalurghat, Chittagong.” মহান মুজিব কর্তৃক ২৬শে মার্চ প্রত্যুষে প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক শ্রী নির্মল সেন তাঁর লেখা “মা জন্মভূমি” -বইয়ের ৫২ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- “ঘোষণাটি ২৬শে মার্চ আমাদের থানার ডাকঘরে এসেছিল। আমি নিজের চোখে সে ঘোষণাটি দেখেছি।”
(৫৪)জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তাঁর স্বকণ্ঠে প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নেতা কাজী আরেফ আহমেদ বিগত ১৯৯০ সনের বিজয় দিবস সংখ্যা “বিচিত্রায়” (অধুনালুপ্ত) প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, “২৫শে মার্চ রাত সাড়ে দশটায় সিরাজুল আলম খান ইকবাল হলে গিয়ে জানান যে, “বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে রেকর্ডকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়ারলেসে প্রচার করা হবে”। তারও পরে উপরোক্ত ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। তাঁর ঢাকা ত্যাগের সাথে সাথেই পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী বাঙ্গালিদের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।
(৫৫)উপরোল্লিখিত ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে সাংবাদিক আতাউস সামাদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সম্ভাব্য আক্রমণের কথা বলাতে, তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলেন- “আমরাও প্রস্তুত। I have given you independence. Now preserve it” [দ্রঃ আজকের কাগজ, ২২-০১-১৯৯৩ ইং]। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী আক্রমণ করার পরপরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। দেশবাসী জানেন, সিরাজুল আলম খান এবং আতাউস সামাদ অদ্যাবধি জীবিত আছেন বটে। তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও এতদসংক্রান্ত ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত হওয়ার সুযোগ এবং অবকাশ রয়েছে।
(৫৬)ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত ড. রওনক জাহান– এর “Pakistan: Failure in National Integration” গ্রন্থে বলা রয়েছে, “২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ২৭শে মার্চ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।” এরই পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে একাধিকবার দল বদলকারী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ একজন বহুরূপী হিসেবে পরিচিত। তিনি ইতিপূর্বে জিয়াউর রহমান, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার মন্ত্রী সভায় অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর রচিত “Bangladesh: Constitutional quest for autonomy” গ্রন্থের ২৫৪ নং পৃষ্ঠায় মেজর জিয়া কর্তৃক ২৭শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথা বলা হয়েছে [দ্রঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আব্দুল মতিন, পৃঃ ৩৪]। একথা ঐতিহাসিকভাবেই সত্যি যে, জিয়াউর রহমানের এহেন ঘোষণা পাঠের দিন তথা ২৭শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয় না। স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয় ২৬শে মার্চ। আর এহেন ২৬শে মার্চ ঢাকাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বঙ্গবন্ধু মুজিব নিজে। যা আমাদের সংবিধানে বর্ণিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১৫০ ও ১৫১ নং অনুচ্ছেদ দুটিতে বিধৃত বক্তব্য সমূহের মাধ্যমে স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত বটে। তাই এরপরেও কি বলা উচিত হবে যে, বঙ্গবন্ধু নহেন জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক?
ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ),লেখক ও কলামিস্ট