ইউরোপ ডেস্কঃ শনিবার সন্ধ্যায় ইতালির রাজধানী রোমের কুইরিনাল প্রাসাদে ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাত্তেরেলার সামনে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মারিও দ্রাঘি শপথ গ্রহণ করেছেন। পরে ইতালির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি রাস্ট্রীয় চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের পর মারিও দ্রাঘি তারঁ মন্ত্রী পরিষদের শপথ পাঠ পরিচালনা করেন।
দ্রাঘি তারঁ মন্ত্রী সভায় পূর্ববর্তী জিউসেপ্প কন্তের সরকারের তিন গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র,পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পুন:রায় তার মন্ত্রিসভায় রেখেছেন। তাছাড়াও তারঁ মন্ত্রীসভায় থাকছে প্রবীণ রাজনীতিবিদ সহ অনেক বিশেষজ্ঞ টেকনোক্র্যাট সদস্য। বর্তমানে করোনায় বিপর্যস্ত ইতালির অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য মারিও দ্রাঘি অর্থমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন অর্থনীতিবিধ ও সাবেক ব্যাংকার ৬৭ বৎসর বয়স্ক ড্যানিয়েল ফ্রাঙ্কোকে। তিনি ব্যাংক অফ ইতালিয়ার সিনিয়র ডেপুটি গভর্নর হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তাছাড়াও তিনি ২০০৫ থেকে ২০১১ পর্যন্ত গভর্নর থাকাকালীন সময়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী দ্রাঘির সাথে একসাথে কাজ করেছেন। তিনি ৯০’ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে একজন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ হিসাবে ইউরোপীয় কমিশনের মহাপরিচালকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তিনি ইতালির স্টেট অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণের ব্যয়ের তদন্তের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে সততার জন্য অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি ইতালির প্রথম মহিলা বিচারমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছেন ৫৭ বৎসর বয়স্কা বিচারপতি মার্টা কার্টাবিয়াকে। তিনি ইতিপূর্বে ইতালির সাংবিধানিক আদালতের প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি এক সময় মিলানের মর্যাদাপূর্ণ বোকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এক তথ্যসূত্রে জানা গেছে বর্তমানে ইতালির বিচারকদের মধ্যে শতকরা ৪৩% শতাংশ মহিলা বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। মারিও দ্রাঘি ইতালির বাস্তুসংস্থান ট্রানজিশন মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছেন দেশের খ্যাতিমান ৫৯ বৎসর বয়স্ক পদার্থবিজ্ঞানী রবার্তো সিঙ্গোলনিকে। সংসদের বৃহত্তম দল পাঁচ তারা আন্দোলন দল দাবী করে আসছিল যে, ইইউ রিকভারি তহবিল থেকে উদ্ভূত অর্থ দেশের সবুজ প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা হোক। এখন সবুজ প্রকল্পের আন্দোলনকারীরা তার দায়িত্ব গ্রহণের ফলে সবুজায়নের ব্যাপারে অনেক আশাবাদী।
পদার্থবিজ্ঞানী রবার্তো সিঙ্গোলনি চার বৎসর যাবৎ জেনোয়াতে ইটালিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বৈজ্ঞানিক পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পর, তিনি সেপ্টেম্বর ২০১৯ সাল থেকে ইতালীয় অ্যারোনটিক্স জায়ান্ট লিওনার্দোতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী ক্লাউস ফন ক্লিটজিংয়ের নির্দেশনায় স্টুটগার্টের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন।
মারিও দ্রাঘি ইতালির অর্থনৈতিক উন্নয়ন পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ জিয়াকার্লো জর্জেটিকে। তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তিও সালভিনিয়ার সুদূর-লিগের একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক খেলোয়াড়। দলটির প্রাক্তন উপ-সচিব, ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি দলের পক্ষে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন। ইতালির জনপ্রিয় পত্রিকা “লা রিপাবলিকা” তাকে একজন উদারপন্থী ও মধ্যমপন্থী নেতা হিসাবে অবিহিত করেছেন। তিনি ব্যাংকিং, অর্থ ও শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিশেষ বিশেষজ্ঞ বলে জানা গেছে। তিনি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জিউসেপে কন্তের প্রথম জোট সরকারে এবং জনসাধারণের ফাইভ স্টার মুভমেন্ট (এম ফাইভ) নিয়ে গঠিত জোট সরকারের সাথে কাজ করেছিলেন।
নতুন প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি জিউসেপ্প কন্তের পূর্ববর্তী সরকার থেকে কিছু মূল মন্ত্রিসভা সদস্যকে ধরে রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন,স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে রবার্তো স্পেরাঞ্জা, বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রী লুই ডি মাইও, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে লুসিয়ানা ল্যামার্জেস এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ড্রারিও ফ্রান্সেসচিনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্পেরাঞ্জা (৪২) সর্বশেষ মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে একজন ছিলেন। তবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এই প্রাক্তন সদস্য ইতালির করোনা মহামারীতে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। কেননা তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন অবস্থায় ইতালিতে করোনার সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তার ও মৃত্যুবরণের ঘটনা ঘটেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে লুই ডি মাইও (৩৪), ২০১৩ সালে পপুলিস্ট ফাইভ স্টার মুভমেন্টের নতুন প্রধান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পার্টির মধ্যে মধ্যপন্থী হিসাবে বিবেচিত, ডি মাইও বিদায়ী কন্তের প্রথম সরকারে ডান নেতা মাত্তিও সালভিনির সাথে সহ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছিলেন।পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে, ডি মাইওকে তার সাবেক উপনিবেশ লিবিয়ার সাথে ইতালির সম্পর্ক ন্যাভিগেট করতে হয়েছে, বর্তমানে গৃহযুদ্ধের ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং মিশরের সাথে রয়েছে, যেখানে কায়রোতে একটি ইতালিয়ান নাগরিকের নিখরচায়িত হত্যাকাণ্ড দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে।
মারিও দ্রাঘি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে রেখেছেন পূর্ববর্তী কন্তের সরকারের প্রবীণ রাজনীতিবিদ লুসিয়ানা ল্যামারগেসকে। এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ ভেনিস ও মিলানের প্রাক্তন প্রিফেট ছিলেন এবং তিনি ইতালির অভিবাসন নীতি পরিচালনা করতে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে সালভিনিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে প্রতিস্থাপন করা হলে লাম্বারজিকে তার পূর্বসূরীর কার্যকালীন সময়ে আরও মধ্যপন্থী পছন্দ হিসাবে দেখা হয়েছিল,যার ইতালির তীরে অভিবাসীদের প্রবেশের অনুমতি প্রত্যাখ্যান এখন আদালতের সামনে।
মারিও দ্রাঘির নতুন সরকারে ৬২ বৎসর বয়স্ক প্রবীণ রাজনীতিবিদ ডারিও ফ্রান্সেসচিনিকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবেই বহাল রেখেছেন। তিনি ২০১৪ সাল থেকেই সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ একজন ঔপন্যাসিক। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একসময় সেক্রেটারির দায়িত্বপালনকারী এই নেতার ইতিমধ্যেই কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
কবির আহমেদ /ইবি টাইমস