আন্তর্জাতিক ডেস্কঃছায়াপথ বা গ্যালাক্সি হ’ল মহাকর্ষীয় শক্তি দ্বারা আবদ্ধ একটি অতি বৃহৎ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা যা তারা, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা,প্লাসমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু দ্বারা গঠিত। একটি আদর্শ ছায়াপথে ১০ মিলিয়ন থেকে এক ট্রিলিয়ন পর্যন্ত তারা থাকে যারা সবাই একটি সাধারণ মহাকর্ষীয় কেন্দ্রের চারদিকে ঘূর্ণায়মান। বিচ্ছিন্ন তারা ছাড়াও ছায়াপথে বহু তারা ব্যবস্থা, তারা স্তবক এবং বিভিন্ন ধরনের নীহারিকা থাকে। অধিকাংশ ছায়াপথের ব্যস কয়েকশ আলোকবর্ষ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত এবং ছায়াপথ সমূহের মধ্যবর্তী দূরত্ব মিলিয়ন আলোকবর্ষের পর্যায়ে। শূণ্যস্থানে আলো এক বৎসরের যে দূরত্ব অতিক্রম করে,তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। আর আলো প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল পাড়ি দিতে পারে।
যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিন “নেচার অ্যাস্ট্রোনমি” জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চিলিতে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির (ESA) মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র আলমা(ALMA) তে স্থাপিত টেলিস্কোপ আতাকামা লার্জ মিলিমিটার / সাব মিলিমিটার অ্যারে (এএলএমএ) ব্যবহার করে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবী থেকে নয় বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে একটি ছায়াপথ ID2299 পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তার নক্ষত্র তৈরীর প্রায় অর্ধেক গ্যাস বের করে দিয়ে জ্বালানি হারাচ্ছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ESA) চিলিতে একটি বৃহৎ টেলিস্কোপ স্থাপন করে রেখেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনেকগুলি ‘মৃত’ ছায়াপথ পর্যবেক্ষণ করেছেন কিন্তু মৃত্যুর প্রক্রিয়াটি এর আগে আর কখনও দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার (সিইএ-স্যাকলে), ফ্রান্সে এক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের ইউনাইটেড ডারহাম ইউনিভার্সিটি ও স্যাক্লে-র নতুন গবেষণার শীর্ষ গবেষক আন্নাগ্রাজিয়া পুগলিসি বলেছেন, প্রথমবারের মতো আমরা একটি বিশাল ঠান্ডা গ্যাস নির্গমনের কারণে ‘মরতে’ যাচ্ছি বলে দূরবর্তী ইউনিভার্সে একটি সাধারণ বিশাল তারকা- তৈরী গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করেছি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো একটি দূরবর্তী ছায়াপথ এর মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছে, যা তারা “অসাধারণ ঘটনা” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
যখন কোনও গ্যালাক্সি বা ছায়পথ এর সমস্ত নক্ষত্র মারা যায় এবং নতুন করে আর কোনো নক্ষত্র তৈরী না হয়, তখন সেই গ্যালাক্সির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। কোন গ্যালাক্সির অন্তর্গত গ্যাসীয় পদার্থসমূহ বের হয়ে গেলে বা নিঃশেষ হয়ে গেলে এটি নতুন করে আর কোনো নক্ষত্র গঠন করতে পারে না। ID2299 নামক স্টারবার্স্ট গ্যালাক্সিটি থেকে পৃথিবীতে পৌঁছতে আলোর জন্য প্রায় নয় বিলিয়ন বছর সময় লেগেছে। সুতরাং, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণকৃত ঘটনাটি ঘটেছিল যখন মহাবিশ্বের বয়স মাত্র সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছর।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন যে ID2299 গ্যালাক্সিটি প্রতিবছর ১০০০০ সূর্য এর সমান গ্যাস হারিয়ে ফেলছে এবং নতুন নক্ষত্র তৈরি করতে প্রয়োজনীয় জ্বালানী দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন অতীতে দুটি গ্যালাক্সি সহিংসভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে একটি গ্যালাক্সিতে পরিণত হয় যার নতুন রুপ হচ্ছে এই ID2299 গ্যালাক্সি। ধারনা করা হচ্ছে নতুন সৃষ্টি হওয়া এই গ্যালাক্সিটি তার গ্যাসীয় মেঘকে ধরে রাখতে ব্যার্থ হয়েছে। ফলে গ্যাসীয় মেঘগুলো উবে যাচ্ছে।
এছাড়াও ছায়াপথটি বর্তমানে তার অভ্যন্তরীণ মূল্যবান গ্যাস ব্যবহার করে মিল্কিওয়ের চেয়েও ১০০ গুণ দ্রুত হারে নতুন নক্ষত্র তৈরি করছে। এ কারণে হয়ত ID2299 ছায়াপথটি অন্যদের তুলনায় খুব দ্রুত (কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই) মারা যাবে। “এই প্রথম আমরা মহাবিশ্ববের গভীরে এক বিশাল তারকা-তৈরির গ্যালাক্সিকে গ্যাস উদগীরণের কারনে নিঃশেষ হতে দেখছি”
এক বিবৃতিতে বলেছেন গবেষণাটির শীর্ষস্থানীয় লেখক আনাগ্রাজিয়া পুগলিসি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, ছায়াপথগুলোর মিশে একত্রিত হওয়ার কারণে তারা এই বিরল “জোয়ারের লেজ (Tidal Tail)” ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। সাধারণত দূরবর্তী ছায়াপথগুলো খুবই উজ্জ্বলহীন দেখায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন ছায়াপথগুলোর একীভূত হওয়ার (Galaitic Marger) প্রত্যক্ষ ফলাফল হচ্ছে নক্ষত্র এবং গ্যাসের এই দীর্ঘ লেজ (Tidal Tail) তৈরি হওয়া। তারা কেবল কয়েক মিনিটের জন্য ছায়াপথটি পর্যবেক্ষণ করেছিল, তবে বিরল এই জোয়ারের লেজটি (Tidal Tail) চিহ্নিত করার জন্য এটি যথেষ্ট ছিল।
এই গবেষণার সহকারী লেখক ইমানুয়েল দাদী বলেন, “আমাদের পর্যাবেক্ষণে দেখা যায় যে একীভূত হওয়া নতুন গ্যালাক্সি থেকেই গ্যাসের নিঃসরণের ঘটনা ঘটে। আর এটি দেখতে জোয়ারের লেজ(Tidal Tail) এর মত একইরকম দেখায়।” তিনি আরো বলেন, ” এই ঘটানাটি ছায়াপথের মৃত্যুবরণ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা বদলে দিতে পারে।”.যদি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গবেষণাটি সঠিক প্রমাণিত হয় (একীভূত হওয়া নতুন গ্যালাক্সি থেকেই বিশাল ভরের গ্যাস উবে যায়), তবে কীভাবে ছায়াপথগুলো তৈরি হয় এবং কীভাবে বিনাশ হয় এবং কীভাবে মারা যায় সে সম্পর্কে পূর্বের তত্ত্বগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। অন্যান্য থিওরীগুলো এতদিন ধারনা দিত যে সক্রিয় ব্ল্যাকহোল বা অত্যধিক নক্ষত্র গঠনে এই জাতীয় ছায়াপথের মৃত্যুর জন্য দায়ী। “এই গবেষণায় নতুন রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এই ধরণের ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নাও হতে পারে।” সহ-লেখক ড. জেরেমি ফেনস আরো বলেছেন, “অতীতের পর্যবেক্ষণ বলে, বহু গ্যালাক্সির এই ‘মহাকর্ষীয় গ্যাস অপসারণ’ দ্বারা ভুক্তভোগী। বিবর্তনের ফলে ছায়াপথগুলোর আকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে দেয় এই ঘটনাটি বড় ধরনের গুরুত্ব রাখবে।
তথ্যসূত্র: CBS নিউজ
কবির আহমেদ /ইবি টাইমস