৫,৩০০ বৎসর পূর্বের অস্ট্রিয়ার আদি মানব “ওটজি”(Ötzi) -এর প্রাকৃতিক মমি উদ্ধার

ইউরোপ ডেস্কঃ অস্ট্রিয়ার আদি মানুষ Ötzi যাকে আইসম্যানও বলা হয়ে থাকে। Ötzi অস্ট্রিয়া ও ইতালির সীমান্তবর্তী আল্পস পর্বতাঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব (ঈসা আঃ এর জন্মের পূর্বে) ৩,৪০০ থেকে ৩,১০০ এর মধ্যে বাস করেছিলেন। তার মমিটি ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রিয়া এবং ইতালির সীমান্তের Ötztal Alps অঞ্চলে পাওয়া যায়। জার্মানির এক দম্পতি শীতকালীন পর্যটক হিসাবে অস্ট্রিয়ার আল্পস পর্বতাঞ্চলে ঘুরতে এসে মমিটিকে বরফে পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অস্ট্রিয়ান সরকার মমি উদ্ধারকারীদের পুরুষ্কৃত করেছেন।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় Ötzi কে উদ্ধারকারী ব্যক্তি কয়েক বৎসর পর সেই Ötztal Alps অঞ্চলে এসে পাহাড়ের বরফ ধ্বসে বরফে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং তিনদিন পর পুলিশ বরফের ভিতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করেন। Ötzi এর মালিকানা নিয়ে ইতালির সাথে অস্ট্রিয়ার বেশ বাকবিতন্ডা হয়েছিল। শেষমেশ Ötzi বর্তমানে অস্ট্রিয়ার Tirol রাজ্যের Medical University of Innsbruck এর বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষিত আছে । Ötzi এর সময়কাল খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৩,৩০০ সাল নাগাদ অর্থাৎ আজ থেকে ৫,৩০০ বৎসর পূর্বের। আল্পস পর্বতাঞ্চলে বরফের নীচে চাপা পড়ে থাকা Ötzi এর মমিটি মিশরের পিরামিডের মমিগুলোর চেয়ে বহু গুন ভালো অবস্থায় পাওয়া গেছে। ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা, ৫০ কেজি ওজনের এবং আনুমানিক ২৫-৩৫ বৎসর বয়স্ক ওটজির নামাকরন করা হয়েছে অস্ট্রিয়ার Tirol রাজ্যের যেখানে তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল সেই Ötztal Alps পর্বতাঞ্চলের নামানুসারে Ötzi।

 

তার মৃত্যুর কারন ময়নাতদন্তের পর বলা হয়েছে যে,তাঁর মাথার পেছন দিকে কেউ খুব জোরে আঘাত করেছিল এবং তাঁর পিছন দিক থেকে একটি পাথরের তীরের ফলা তাঁর পাঁজর ভেদ করে বের হয়ে যাওয়ার ফলে তার মৃত্যু ঘটেছিল। তিনি কি যোদ্ধা ছিলেন, না এটা সাধারন খুনাখুনি সেটা বলা কঠিন। তবে মৃত্যুর পূর্বে তিনি চারজনকে আহত করেছিলেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের দল। তাঁর হাতের অস্ত্রে চারজন আলাদা আলাদা মানুষের রক্তের অস্তিত্বের সন্ধ্যান পেয়েছেন বিজ্ঞানীদের দল। Ötzi পাহাড়ের বাসিন্দা ছিলেন না, তবু কেন তিনি ঐ তিন হাজার ফুট (৩,০০০ হাজার) উঁচুতে এসেছিলেন তা জানা সম্ভব হয় নি।

২৫ থেকে ৩৫ বৎসরের Ötzi ছিলেন আল্পস পর্বতাঞ্চলের পাদদেশের সমতল এলাকার বাসিন্দা। তবে Ötzi দীর্ঘকাল কায়িক পরিশ্রমের দরুণ হয়তো তাকে বয়সের তুলনায় যথেষ্ট বয়স্ক দেখাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের দল কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে সে দেখতে কেমন ছিল তার একটি স্থির চিত্র বা ফটো অঙ্কন করতে সক্ষম হন। বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের দল তাঁর হাড়ের ক্ষয় দেখতে পেয়েছেন। তিনি যে,পাহাড়ের লোক ছিলেন না তা জানা গেল তাঁর পেটে খাবারের কনা থেকে। সেই খাবারের শষ্য উৎপন্ন হয় সমতলেই। মারা যাবার পাঁচ ঘন্টা পূর্বে তিনি হরিণের মাংস আর শষ্য দানার খাবার গেয়েছিলেন।

অস্ট্রিয়ার ৫,৩০০ বৎসর পূর্বের আদি মানুষ Ötzi পেটের পীড়ায় ভুগছিলেন। ময়নাতদন্তে তাঁর পেটের ভিতর বড় বড় কৃমির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। খাবার খেয়ে বেশ প্রস্তুত হয়েই পাহাড়ের পথে রওনা দিয়েছিলেন Ötzi। সে সময় তাঁর পরনে ছিল অন্তর্বাস হিসাবে ভেড়ার চামড়া। চামড়ার উপরে ছিল ঘাষের তৈরী পোষাকের আস্তরন। পায়ে ছিল জুতো যা দড়ি দিয়ে বোনা এবং জুতার সামনের দিকে চামড়া ছিল। আর পায়ের তলার দিকে প্যাডিং-এর জন্য ছিল ঘাস। হাতে ছিল কাঠের হাতল সহ তামার কুড়াল, পাথরের ফলা সহ তীর ও ধনুক। Ötzi এর দেহের ডি.এন.এ পরীক্ষা করে ইতালির সার্ডিনিয়া অঞ্চলে তাঁর বহু বংশধরের সন্ধান পাওয়া গেছে।

তাঁর মমিটি যখন উদ্ধার হয়,তখন এটি সমগ্র বিশ্বের সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। Ötzi আধুনিক বিজ্ঞানীদের কাছে এটি একটি অমুল্য সম্পদ। যেহেতু তার জিন ম্যাপিং করা হয়ে গেছে তাই তার চেহারা কম্পিউটারে তৈরী করতে বিজ্ঞানীদের খুব একটা কষ্ট হয় নি। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা জানতে চান Ötzi র কন্ঠস্বর কেমন ছিল। তাঁর কন্ঠস্বর শুনতে হলে তার স্বরনালী নতুন করে তৈরী করতেই হবে। কিন্তু সে জন্য দরকার Ötzi র স্বরনালীর গঠন নিখুঁত ভাবে জানা। তা সেটা তো এক্স-রে করে বা সিটি স্ক্যান করে করা যেতেই পারে। কিন্তু না ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না। কারন ওটজির একটা হাত তার গলার উপর ছিল। সেই হাতের জন্য কিছুতেই ঠিকঠাক ভাবে গলার ভেতরের স্বরনালীর সঠিক চেহারা ধরা যাচ্ছিল না। অবশেষে অত্যাধুনিক ষন্ত্রপাতির সাহায্যে সেটা সম্ভব হয়েছে। একবার তার স্বরনালীর গঠন জানা হয়ে গেলে বাকী কাজ তো বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই সহজ। তাঁরা কৃত্রিম স্বরনালী বানিয়ে ফেললেন। সফটওয়্যার তৈরী হয়ে গেল। এখন আমরা ওটজির গলার স্বরও শুনতে পারি। যেহেতু আমরা কেউ জানি না Ötzi কোন ভাষায় কথা বলতেন, তাই বিজ্ঞানীরা Ötzi র গলায় আমাদের শোনালেন শুধু A,E,I,O,U । পাঁচ হাজার তিনশ বৎসর আগে মৃত Ötzi এখন আমাদের শোনাচ্ছেন A,E,I,O ও U। সেই কন্ঠস্বর এখন ইউটিউবে আমরা সবাই শুনতে পাচ্ছি। Ötzi কে পেয়ে অস্ট্রিয়ানরা অনেক গর্বিত।

তথ্যসূত্রঃ-Encyclopedia Britannica Ötzi-Reconstruction of Ötzi based on forensic analysis of the mummy; in the South Tyrol Museum Austria.

কবির আহমেদ /ইবি টাইমস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »