মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত।এটি লেখকের নিজস্ব মতামত।এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই
পর্ব-৩
ড. মোঃ ফজলুর রহমানঃ (১৯)উপরোল্লিখিত ঘোষণার মাধ্যমে তিনি বলেন-“এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে, তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবিলা করার জন্য আমি আহবান জানাচ্ছি । পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। জয় বাংলা।” [দ্রঃ বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশনা- বঙ্গবন্ধু স্পিকস্, (মূলঃ ইংরেজী) ১৯৭২]।
(২০)বঙ্গবন্ধু কর্তৃক উপরোল্লিখিত ঘোষণা প্রদানের সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় যে সব বাঙালি কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই উক্ত ঘোষণাপত্র পেয়েছিলেন বটে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো উক্ত ঘোষণাপত্রের কপি সংরক্ষণ করে চলেছেন। উপরোল্লিখিত জেলা প্রশাসকদের মধ্যে যারা অদ্যাবধি জীবিত রয়েছেন, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এতদসংক্রান্ত ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
(২১)একথা ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য যে, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিব ২৫শে মার্চ রাতে তাঁর ৩২ নং ধানমন্ডির বাসভবন থেকে কোথাও পালিয়ে যাননি। তাঁর সহকর্মীদেরকে আত্মগোপনের নির্দেশ দিলেও তিনি নিজে আত্মগোপন করেননি। ঐ রাতে তিনি সশরীরে তাঁর বাড়িতে অবস্থান করে পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার বরণ করেন। পরে পাক বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে ঐ রাতেই পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। ১৯৬৯ -এর গণ অভ্যুত্থানের সময়ে পাকিস্তানী শাসকবর্গ দেখেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে সুরক্ষিত ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে আটকে রাখাও নিরাপদ নয়। বীরের জাতি বাঙালি দুর্বার এবং দুর্দমনীয় আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের প্রিয় নেতাকে তারা মুক্ত করেই ছাড়ে। এহেন অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সামরিক জান্তারা ২৫শে মার্চের রাতে আর সে রকম কোন ঝুঁকি নেননি।
(২২)বঙ্গবন্ধুর উপরোক্ত গ্রেফতার তথা স্বেচ্ছাবন্দিত্বকে অনেকেই আত্মসমর্পণ হিসেবে ব্যঙ্গ করে থাকেন। কিন্তু স্বীকৃত মতেই স্বেচ্ছাবন্দিত্ব এবং আত্মসমর্পণ কোন সমার্থক শব্দ নয়। উপরোক্ত শব্দ দুটি ভাষাগত দিক দিয়েই বিপরীতার্থক শব্দ বটে। স্বেচ্ছাবন্দিত্ব সংগ্রামেরই একটি চূড়ান্ত প্রক্রিয়া ও কৌশল। পক্ষান্তরে আত্মসমর্পণ হলো নিজের ইচ্ছাকে বিকিয়ে তথা জলাঞ্জলি দিয়ে বিজয়ীর নিকট নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেয়া। ২৫শে মার্চের কালো রাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের বাসভবন থেকেই গ্রেফতার হন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে যান এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন।
(২৩)পরবর্তীকালে সকল নেতৃবৃন্দ প্রথমে ভারতে এবং পরে মেহেরপুর জেলার আম্রকাননে মিলিত হন। তারও পরে মুজিব নগরে এসে প্রবাসী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের এহেন গ্রেফতার এড়ানো তথা আত্মগোপন করে ভারতে গমন, মুজিবনগরে এসে প্রবাসী সরকার গঠন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন সংক্রান্ত সমুদয় কার্যক্রম দূরদর্শী মুজিবের পূর্ব পরিকল্পনা এবং সুচিন্তিত দিক নির্দেশনার আলোকেই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিন্দুকের ভাষ্য মোতাবেক বঙ্গবন্ধু যদি নিজেকে আত্মসমপর্ণই করে থাকেন, তাহলে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে কখনো লায়ালপুর আবার কখনোবা মিয়ানওয়ালী কারাগারে তাঁকে সুদীর্ঘ ৯ (নয়) টি মাস ধরে আটক রাখা সত্ত্বেও পাকিস্তানী শাসকবর্গ তাঁর মুখ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মামুলি একটি বিবৃতি কিংবা একটি শব্দও আদায় করতে পারেননি কেন?
(২৪)ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে, বর্তমান তুরস্কের কুর্দি সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন জনাব আব্দুল্লাহ ওকালান। স্বাধীন কুর্দিস্তানের জন্য তুরস্কের সঙ্গে তিনি আজীবন যুদ্ধ করে এসেছেন। পরবর্তীকালে সেই ওকালান তুরস্কের হাতে বন্দি হন। এহেন বন্দি হওয়ার কিছুদিন পরেই জানা গেল যে, প্রাণ ভয়ে ভীত উপরোক্ত আব্দুল্লাহ ওকালান স্বাধীন কুর্দিস্তানের দাবী থেকে সরে এসেছেন। এর অব্যবহিত পরে তিনি কুর্দি গেরিলাদেরকে অস্ত্র সংবরণের জন্য আবেদন জানান। কুর্দিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামের বর্তমান হাল হকিকত সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত এবং অবহিত রয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকাবস্থায়ও অকুতোভয় মুজিব একটি মুহূর্তের জন্যও মাথা নত করেননি। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা সত্ত্বেও দুরাচার জান্তার নিকট দুর্বিনীত মুজিব তাঁর মাথা নোয়াননি। উপরন্তু বিদ্রোহী কবি নজরুলের ভাষায় বলেছেন- “শির দেগা নাহি দেগা আমামা”। বাংলা মায়ের এহেন কালজয়ী বীর ও মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধুর নাম শুনলেই আজ যাদের গাত্রদাহ শুরু হয়, তারা যে আইউব, ইয়াহিয়া, ভূট্টো এবং টিক্কা খানদের দোসর ও অনুসারী এবং অন্ধ মুজিব বিদ্বেষী তাতে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই।
(২৫)পৃথিবীর ইতিহাসে স্বেচ্ছাবন্দিত্বের কোন নজির কিংবা কোন উদাহরণ নেই বলে মুজিব বিরোধীরা সুযোগ পেলেই প্রচার করে থাকেন। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা। কিন্তু এহেন লক্ষ্য অর্জনে তিনি কখনো সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যাননি। তদস্থলে নিরবচ্ছিন্নভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। তিনিও তাঁর দেশ ছেড়ে কখনো পালিয়ে যাননি কিংবা কখনো আত্মগোপন ও করেননি। আর তা না করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে গিয়ে অসংখ্যবার স্বেচ্ছাবন্দিত্ব তথা কারাবরণ করেছেন। গান্ধীজীর এহেন স্বেচ্ছা কারাবরণ নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা তিনি আততায়ীর হাতে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পরেও কেউ কখনো কোন প্রশ্ন তুলেননি এবং এখনো তুলছেন না।
(২৬)মহাত্মা গান্ধীর আরেক সুযোগ্য উত্তরসূরী হচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। গান্ধীজীর মতো তিনিও কখনো তাঁর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি কিংবা আত্মগোপন ও করেননি। তিনিও স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করে সুদীর্ঘ ২৭ (সাতাশ) টি বছর কারা প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করেছেন। মহাত্মা গান্ধী এবং নেলসন ম্যান্ডেলা আত্মসমর্পণ করেছেন বলে তাঁদের ঘোরতর শত্রুরাও কখনো বলেননি এবং এখনো বলেন না। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, মহাত্মা গান্ধী এবং নেলসন ম্যান্ডেলার উপরোক্ত দৃষ্টান্ত সমূহ অনুসরণ করেছেন মাত্র। গান্ধীজী এবং ম্যান্ডেলার উপরোল্লিখিত জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত সমূহ সামনে থাকা সত্ত্বেও যে সমস্ত কপটচারীগণ নিতান্তই অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে বিভিন্ন ধরনের অযুক্তি এবং কুযুক্তির মাধ্যমে সজ্ঞানে মিথ্যাচার করে মুজিব চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করতে চান, যে কোন বিবেচনায়ই তারা ডাহা মিথ্যাবাদী (Blatant liar) এবং জ্ঞানপাপী বটেন।
(২৭)স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত উপরোল্লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে “মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাস” – গ্রন্থের ৭০৯ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছে- “২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর আক্রমণের কথা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে হরিরামপুর থানায় পৌঁছলে, সেখানকার দেশপ্রেমিক জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।” উপরোক্ত একই ব্যাপারে “বাখরগঞ্জ জেলার ইতিহাস” – বইয়ের ৫৯১ নং পৃষ্ঠায় বিধৃত রয়েছে – “২৬শে মার্চ সকাল ৮-০০ ঘটিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তা নূরুল ইসলাম মঞ্জু (সংসদ সদস্য) পান এবং তিনি উক্ত তারবার্তাটির অনুলিপি পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও ভোলায় পাঠিয়ে দেন।” [দ্রঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আব্দুল মতিন, পৃষ্ঠা নং ৩৪]
ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ),লেখক ও কলামিস্ট
( চলমান )