সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক

মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে ড. মোঃ ফজলুর রহমানের ধারাবাহিক মতামত। এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে ইউরোবাংলা টাইমসের সম্পাদকীয় নীতিমালার সম্পর্ক নেই।

পর্ব-১ 

(১)বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অর্জন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। কোন  ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ কিংবা পারদর্শী অথবা বিদগ্ধ জ্ঞানী না হয়েও যে কোন সাধারণ মানুষই জানেন এবং স্বীকার করেন যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা কোন আকস্মিক ঘটনা নহে। এ দেশের স্বাধীনতা কোন আলাপ আলোচনা কিংবা চুপি চুপি কোন চুক্তি অথবা কোন আপোষের চোরাগলি পথে আসেনি। স্বাধীনতা এসেছে সুদীর্ঘ দিনের সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, অপরিমেয় রক্ত ও অশ্রু এবং অবর্ণনীয় ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে।

(২)আমরা সবাই জানি যে, ছলে – বলে এবং কৌশলে পাকিস্তানী শাসক বর্গের সুদীর্ঘ চব্বিশ বছরের শাসন, শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়নের প্রেক্ষিতে অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতি বরাবরই ছিল ক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ এবং প্রতিবাদ মুখর। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ -এর সাধারণ নির্বাচনে। উক্ত নির্বাচনে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬৯ টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল পান মোট ১৬৭ টি আসন। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের মোট আসনের মধ্যে ভূট্টোর ভাগ্যে জোটে মাত্র (৮৩ + ৫) = ৮৮ টি আসন।

(৩)একথা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য যে, অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোয় পূর্ব বাংলার জনগণের সর্বোচ্চ স্বায়ত্ত্ব শাসন নিশ্চিত করার ঐকান্তিক প্রত্যাশায় বিগত ১৯৬৬ ইং সনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন। আর এহেন ৬ দফার সমর্থনে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে তিনি দেশবাসীর নিকট থেকে বিপুল পরিমাণে গণ রায় প্রাপ্ত হন। তাই অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কারণেই অখণ্ড পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাতেই ক্ষমতা অর্পণ করা পাকিস্তানের শাসক বর্গের উচিত ছিল বটে। কিন্তু ভূট্টোর চাপে এবং নানা মুখী ষড়যন্ত্রের কারণে আওয়ামীলীগ তথা বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা থেকে বিরত থাকেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান

(৪)একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা থেকে তিনি শুধু বিরত থেকেই ক্ষান্ত হননি। উপরন্তু বিগত ১৯৭১ ইং সনের ১লা মার্চ বেতার এবং টিভিতে প্রচারিত ভাষণের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ফলে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো পুরো বাঙালি জাতি। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মিটিং মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে থাকলো তারা অত্যন্ত সোচ্চার ভাবে। বিজাতীয় পাকিস্তানী শাসকদের কবল থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মুক্তি পাগল বাঙ্গালির আন্দোলন দিন দিনই অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করতে থাকলো। অগত্যা ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে।

(৫)এ সময়ে অসীম সাহস, পরম ধৈর্য এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে নেতৃত্ব দিতে থাকেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। তাঁরই নির্দেশে আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলি প্রতিদিনই সভা, সমাবেশ, মিছিল এবং মিটিং – এর মাধ্যমে স্বাধীনতার দাবিতে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকলো। এহেন প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মুখেই এসে গেল বহুল প্রত্যাশিত ৭ই মার্চ। বাঙ্গালির স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ই মার্চ একটি অনন্য সাধারণ দিন। মহাকালের অসীম কালো অধ্যায় পেরিয়ে অপেক্ষমাণ বাঙালি জাতি এদিন তাদের প্রাণ প্রিয় নেতার নিকট থেকে পেল অধিকার আদায়ের সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা। বাঙ্গালির ইতিহাসের বিশাল পাণ্ডুলিপি রচনার সূত্রপাত ঘটল এ দিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা হোয়াইট হাউস থেকে লিখে আনা হয়েছিল।পক্ষান্তরে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু মুজিব বিশাল জনসমুদ্রে তাৎক্ষণিকভাবে যে ভাষণ দেন, তা ছিল অলিখিত এবং তাঁর দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার সুচিন্তিত ফসল।

(৬)ইতিহাসের মহামানব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু এদিন অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং তেজোদীপ্ত কণ্ঠে তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিকামী ১০ (দশ) লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে অমিত তেজ ও পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠে এবং অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, গুরুত্ব এবং তাৎপর্যের দিক দিয়ে তা সারা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তাই ৭ই মার্চ বাঙ্গালির সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম এবং দুরতিক্রম্য পথের প্রান্তে অত্যুজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা। ব্যাপক জনসমাবেশের বিশালত্ব, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা এবং নজির বিহীন গণজাগরণ ও গণসমুদ্রের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও উচ্ছ্বাসের দিক দিয়ে এই দিনটি বাঙালির ইতিহাসে চির অম্লান, চির ভাস্বর।

(৭)স্বাধীনতার উত্তাল তরঙ্গে দোদুল্যমান লক্ষ লক্ষ জনতার বিশাল সমাবেশে এদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যের দৃঢ়তা এবং জোরালো বাগ্মিতার মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এমতাবস্থায় চিরকালীন অবহেলিত এবং বৈষম্য পীড়িত একটি জনগোষ্ঠীর অসহায় এবং করুণ আর্তনাদের ঘটনাবলী সম্বলিত ভাষণের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী সাময়িকী News week -১৯৭১ -এর ৫ই এপ্রিল প্রকাশিত তাদের প্রচ্ছদ নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে Poet of politics বা “রাজনীতির কবি” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় [দ্রঃ সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির শ্রেষ্ঠ ভাষণ- আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, উপাচার্য (প্রাক্তন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সূত্র- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারক গ্রন্থ- ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৭০৩]।

(৮)পাকিস্তানী শাসক চক্র চেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু এদিন (৭ই মার্চ) স্বাধীনতার ঘোষণা দিক। তাহলে সীমাহীন দেশপ্রেম এবং অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধুকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যেত। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ফেলার তথা ধ্বংস করার হোতা হিসেবে মুজিবকে বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরতে পাকিস্তানী জান্তার কাছে সহজ হয়ে যেত। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা যেত কিংবা সে আন্দোলনকে ভণ্ডুল অথবা প্রতিহত করার নিমিত্তে আরও বেশ কিছু দিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হতো। এরই পাশাপাশি অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুক্তি দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা পেয়ে যেত।

(৯)পাকিস্তানী শাসকবর্গের এহেন পরিকল্পিত কূট চাল সফল হয়নি। অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং মেধা ও মননের সমন্বয় ঘটিয়ে দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু তাদের পাতানো ফাঁদে পা দেননি। তাই তিনি ঐদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কিন্তু তা না দিয়ে এদিন সবার চোখের সামনে এবং সবাইকে বোকা বানিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে সুচিন্তিত শব্দ চয়ন, সুগঠিত বাক্য বিন্যাস এবং সুবিন্যস্ত বাক্য সংযোজনের মাধ্যমে কখনো আবেগ তাড়িত ভাবে আবার কখনো বা সমুদ্রের গর্জনের মতো তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার যে আহবান জানান, পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা তাতে বিস্মিত এবং হতভম্ব হয়ে যায়। তাদের মুখা বয়বে চিন্তার বলিরেখা প্রতিভাত হয়ে উঠে। ইতিহাসের মহানায়ক ঐদিন অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন- “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” উপরোক্ত একই ভাষণে তিনি আরও বলেন- “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাহ্‌ আল্লাহ্‌। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

ড. মোঃ ফজলুর রহমান,সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অবঃ),লেখক ও কলামিস্ট

( চলমান)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit exceeded. Please complete the captcha once again.

Translate »