চরফ্যাশন (ভোলা): জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে হুমকির মুখে জেলে জীবন। ধারাবাহিকভাবে নদী ও সমুদ্রে জীবিকা নির্বাহের পথ পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে। এমনটাই দাবি করছেন চরাঞ্চলের জেলেরা।
বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস , টর্নেডোর কারণে নদী ভাঙন ও জোয়ারের গতির তীব্রতায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, কমেছে নদী-সমুদ্রে মাছের উৎপাদন। একমাত্র পেশা জেলে জীবন ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন অনেক জেলে। এছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে না পাওয়ায় কোন কোন জেলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
উপজেলার নদী ও সমুদ্র মোহনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন, সেইসব জেলেরা জানান, নদীতে এখন আর আগের মতো মাছ মেলেনা। পরিবেশের সঙ্গে মানুষের অযাচিত আচরণের কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে। মাছ না পাওয়ায় তারা পরিবার নিয়ে শঙ্কিত। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ বদলে ফেলছেন পেশা। অন্য কাজের সন্ধানে এলাকাও ছাড়ছেন অনেক জেলে পরিবার।
ভাঙ্গন কবলিত নদী উপকূলে বসবাসরত জেলেদের প্রতি বছরে একাধিকবার বসতবাড়ি অন্যত্র স্থাপন করতে হয়। সেই সঙ্গে জেলে শিশুরাও স্বপ্ন ভাঙা শৈশবের স্মৃতি বয়ে বেড়ায় সাড়া জীবন। উপকূলের জীবনটাই যেন দুঃস্বপ্ন। সাগরের ভয়ঙ্কর উম্মত্ততা আর দাদনের শোষণ ছাড়া জীবনে তেমন কিছুই মেলেনা জেলদের।
চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের জেলে আবদুর রহিম (৫২), নাসির (৭২), বেলাল (৩৪), ফারুক (৩৫) ও আবদুস সালাম (৫২) বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে সাগরে গিয়ে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া বন্যা, তুফানের মধ্যে মাছ শিকার করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই যুগ আগেও নদী-সাগরে মাছ শিকার করে অনেক জেলেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে রাতারাতি জীবন বদলে ফেলতেন। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে।
জেলেদের জীবিকা নির্বাহে সংকট দেখা দেয়ায়, মেঘনার উপকূল ঘেষা খালে ও চরাঞ্চলে শত শত ট্রলার এখন অলস পড়ে থাকে।রঙিন পতাকাগুলো বাতাসে উড়তে দেখা গেলেও সকাল দুপুর ও পড়ন্ত বিকেল শেষেও ডিঙ্গি বা ট্রলারের মাছ ধরতে যাওয়ার তাড়াহুড়ো চোখে পড়েনা।
চরফ্যাশন উপজেলা জলবায়ু ফোরামের সভাপতি এম আবু সিদ্দিক বলেন, জলবায়ুর চিত্রপট পাল্টে যাওয়ায় ঋতু চক্রের ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে কারণে নদী ও সাগরে মাছের বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন হয়েছে। অনভিজ্ঞ জেলেরা ঘুরে ফিরে একই এলাকায় মৎস্য শিকারে যাওয়ায় মাছ কম পাচ্ছে তারা। এছাড়া বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পানির উচ্চতা ও জোয়ারের গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হয়েছে। এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। বৈশ্বিকভাবে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব না কমাতে পারলে পুরো উপকূলের মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে মনে করেন তিনি।
চরফ্যাশনের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের ভোলা জেলা সহকারী পরিচালক রাশিদা বেগম জানান, কার্বনের উষ্ণতায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলে নদী ও সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে। প্রতিবছরের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও টর্নেডো এবং লবণাক্ততা বাড়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শিকার হতে হচ্ছে খেটে খাওয়া জেলে ও উপকূলের সাধারণ মানুষের।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হেসেন মিনারের সঙ্গে কথা বললে তিনি ইউরোবাংলা টাইমসকে বলেন, সম্প্রতি অতি বৃষ্টির রেকর্ড বিগত ১০ বছরের চেয়ে বেশি হওয়ায় এবং আগের বছরগুলোর তুলনায় ঝড়-বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় নদী ও সমুদ্রে জীবিকা নির্বাহে জেলে পেশা কমছে। তবে তিনি দাবি করেন, নদী ও সাগরে ছোট মাছের সংখ্যা কমলেও বড় মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অঞ্চলের জেলেরা মূলত দিন এনে দিন খাওয়ার ফলে মাছের অভয়ারণ্য গভীর সমুদ্রে তারা কম যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, স্থানীয় নদী উপকূলে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র পাল্টে যাওয়ায় উপকূলীয় নদীতে মাছের সংখ্যা কমেছে। জেলেরা এসব অঞ্চলে মৎস্য শিকারে যাওয়ায় সম্প্রতি মাছের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে জেলেরা যদি সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাছের অভয়ারণ্য গভীর সমুদ্র ও নদীতে মাছের বিচরণ এলাকায় যায় তাহলে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। পাশাপাশি তারা সঠিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ভোলা-২ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, চরফ্যাশন উপজেলার নদীভাঙন কবলিত এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও কার্বন নিঃসরণে বেড়িবাঁধের ঢালে বৃক্ষ রোপণও করা হচ্ছে।
মোঃতরিকুল ইসলাম/ ইউবি টাইমস