ভারতের কিংবদন্তী সাবেক রাষ্ট্রপতি দার্শনিক এপিজে আব্দুল কালাম বলেছিলেন ” ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেটা দেখা হয় সেটা স্বপ্ন নয় ; স্বপ্ন সেটাই যা মানুষকে ঘুমোতে দেয়না ” । অর্থাৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রাণপণ তাড়ণা সেই সাথে কঠোর প্রয়াস- এর নাম স্বপ্ন । বাংলাদেশের সতেরো কোটি মানুষ এবং তাদের প্রাণের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বুকভরা ভালোবাসা থেকে সতোৎসারিত স্বপ্নের নাম “পদ্মা সেতু” । নিজেদের টাকায় নিজেদের শ্রমে স্বপ্ন থেকে বাস্তবের অভ্রনাশী অবকাঠামো পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয় নিকট বাস্তব ।
‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’ বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু। এর মাধ্যমে লৌহজং, মুন্সিগঞ্জের সাথে শরিয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে, ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে এর ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প।
তথ্য অনুযায়ী সেতুটির নির্মাণ শুরু ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত মূল সেতুর ৭৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে ২০২১ সাল নাগাদ ।সরকারের পরিকল্পনামাফিক এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ।
মূল সেতু : পদ্মা সেতুর মূল অংশ নির্মাণের জন্য চীনের ‘ চায়না মেজর ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেড ‘ – এর সাথে ২০১৪ সালের জুনে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । একই বছরের নভেম্বর মাসে কাজ শুরুর আদেশ পায় প্রতিষ্ঠানটি ।
একনজরে জেনে নেয়া যাক কী কী আছে পদ্মা সেতুতে :
……………………………………………………………………..
১. পদ্মা সেতুর প্রকল্পের নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’।
২. পদ্মা সেতুর ধরণ দ্বিতলবিশিষ্ট। এই সেতু কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে।
৩. পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় (মূল সেতুতে) ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
৪. ২০১৭-১৮ অর্থবছর পদ্মাসেতু প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ ৫২৪ কোটি টাকা।
৫. পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসন ব্যয় ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
৬. পদ্মা সেতু প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড।
৭. পদ্মা সেতুতে থাকবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ পরিবহন সুবিধা।
৮. পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন হবে নিচ তলায়।
৯. পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক।
১০. পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।
১১. পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটর।
১২. পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার।
১৩. পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসন হয়েছে দুই পাড়ে ১২ কিলোমিটার।
১৪. পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ।
১৫. পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি।
১৬. পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা হবে ৬০ ফুট।
১৭. পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা ৩৮৩ ফুট।
১৮. পদ্মা সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি।
১৮. প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং হবে ৬টি।
১৯. পদ্মা সেতুর মোট পাইলিংয়ের সংখ্যা ২৬৪টি।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশীদের জন্য একটি গর্বের বিষয় এবং এটি আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এটা পৃথিবীর বুকে আবার বাঙালি জাতির নাম উজ্জল করেছে। বিশ্ব দরবারে এটি প্রমাণ করে দিয়েছে বাঙালি জাতি এখন আর পিছিয়ে নেই। পদ্মা সেতুর মতো বিভিন্ন প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার মতো ক্ষমতা রাখে বাংলাদেশ। মিথ্যা দুর্নীতি মামলায় বিশ্বব্যাংকের এবং অন্যান্য আর্থিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সরে যাওয়ার সঠিক জবাব হয়েছে এটি।
জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে পদ্মা সেতু:
পদ্মা সেতুর কারণে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে এমন পূর্বাভাস জাইকার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে ১ শতাংশের বেশি । অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, সেতুটির কারণে বদলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীবন-যাত্রা। বাড়বে বাণিজ্য, গড়ে উঠবে কল-কারখানা। একইসঙ্গে পরিবহন যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আসবে আমূল পরিবর্তন। কারণ সেতুটির মাধ্যমে ১৯ টি জেলার সরাসরি যুক্ত হবে ঢাকার সাথে। অন্যদিকে ঢাকার সাথে কলকাতার যোগাযোগ সহজ হবে ফলে দ্বিপাক্ষিয় বাণিজ্যের উন্নয়ন ঘটবে।
এককথায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম ঈশান অগ্নি নৈঋত বায়ু সব পয়েন্টের মানুষের যাপিতজীবনে আসবে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের তুমুল সুদিন । বাংলাদেশের উন্নয়নবাদী নাগরিকগণ বলা শুরু করবে- “বিশ্বজগত দেখবো আমি আপনাদের হাতের মুঠোয় পুরে” ।
জয়তু পদ্মাসেতু । জয়তু বাংলাদেশ ।
রিপন শান, কবি ও
সাংবাদিক
Good luck for the race. I hope you will win this game.